ঢাকা ০৮:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo আওয়ামী দোসরদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে সরকার সফল হবে না: তারেক Logo স্বৈরাচারের হিংস্র থাবা থেকে দেশ এখনও মুক্ত নয়: রিজভী Logo হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে যেভাবে ইসরায়েল খুঁজে বের করে হত্যা করেছে Logo সোনারগাঁওয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে যুবকের মৃত্যু Logo সংবাদ প্রকাশের পর বৃদ্ধা মহিলার ঠাই হলো স্বামীর বসত ভিটায় Logo সোনারগাঁয়ে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারি হালট দখল করে বালু ভরাট Logo ‘সংস্কারের ধীর গতি’ ও কাজের গুরুত্ব নির্ধারণ নিয়ে সমালোচনা, কী বলছেন উপদেষ্টারা? Logo আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু আজ Logo বাড়তে পারে ঈদ ও পূজার সরকারি ছুটি Logo আগামী বছর থেকে আবারও মাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজন শুরু

নির্বাচনের পরের অর্থনীতি নিয়ে যত শঙ্কা

সারাবেলা প্রতিবেদন
  • আপডেট সময় : ০১:৩০:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৩ ৫৫ বার পঠিত
বাংলাদেশ এখন বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপের মুখে পড়ছে৷ কমছে রিজার্ভ, বাড়ছে ডলার সংকট৷ রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সেও ভাটার টান৷

আগামী ৭ জানুয়াারি বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন৷ ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন ছিল৷ ৩০০ আসনের নির্বাচনে দুই হাজার ৭৪১ জন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন ৷ প্রতি আসনে লড়তে চাচ্ছেন গড়ে ৯ জনেরও বেশি প্রার্থী৷ নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০ টি দল নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে৷ তবে সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ আরো কিছু দল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না৷

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে নির্বাচন নিয়ে একটি বৈরি পরিস্থিতি চলছে৷ আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ আছে৷ কিন্তু তার মধ্যেও দেশ একপাক্ষিক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে৷ এই পরিস্থিতির কারণে সরকারের অর্থনীতির দিকে যে নজর দেয়ার দরকার৷ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী গত বুধবার বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ আরো কমে ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে৷ বুধবারের আগে তা ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার ছিল৷ তবে দায়হীন বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলার৷

২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়৷ তা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ৷ এরপর থেকেই রিজার্ভের ‘ক্ষয়’ শুরু হয়৷ গত দুই বছর ধরে প্রতি মাসে গড়ে এক বিলিয়ন ডলার করে রিজার্ভ কমেছে৷ আমদানি কমার পরও জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ডলার ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯৩ কোটি ডলার৷ ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় থামানো যাচ্ছে না৷ অন্যদিকে রপ্তানি আয় কমছে৷

অক্টোবর মাসে ৩৭৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা ২৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩.৬৪ শতাংশ কম৷ তবে আগের মাস সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে৷ তার আগের দুই মাস জুলাই ও আগস্টে রপ্তানি বেড়েছিল যথাক্রমে ১৫ ও ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ৷

প্রবাসী আয় কয়েক মাস কমে আবার বাড়া শুরু করেছে৷ নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধে প্রবাসী আয় বেড়েছে৷ প্রথম ১৫ দিনে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি৷ গত বছর একই সময়ে এসেছিল ৯২ কোটি ডলার৷ কিন্তু এর ইতিবাচক প্রভাব  রিজার্ভে পড়ছে না৷

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয় (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘যে অর্থনেতিক সংস্কারগুলো দীর্ঘদিন ধরে করা দরকার ছিল, সেগুলো আরো পিছিয়ে নির্বাচনের পরে করার কথা বলা হচ্ছে৷ এটা কোনো সঠিক চিন্তা নয়, কারণ, আমাদের অর্থনৈতিক সংকটের এখন যা ধরন, সেটা দূর করতে পদক্ষেপ নিতে আমরা যদি আরো দেরি করি, তাতে সংকট আরো গভীর হবে৷’’

তার কথা, ‘‘মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভের পতন যদি ঠেকানো না যায়, তাহলে সংকট আরো বাড়বে৷ এটার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যাপক সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক ঐক্যমত দরকার, সেটার কোনো লক্ষণ আমি দেখছি না৷’’

‘আমি আগেও বলেছি, বিদেশি ঋণে যেসব মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে, তার রিভিউ প্রয়োজন৷ এর প্রয়োজনীয়তার দিক বিবেচনা করে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা প্রয়োজন৷ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি যেগুলো জরুরি নয় সেগুলো বাস্তবায়নের বাইরে রাখা উচিত৷ প্রতি বছরই আমাদের বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে৷ আর এটা শোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায় (ডলারে)৷ আর এজন্য রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই৷ আমাদের দেখতে হবে যে প্রকল্পগুলো আছে, সেগুলো রপ্তানি উন্নয়নে ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কতটা কাজে লাগবে,’’ বলেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান৷

তার কথা, ‘‘মার্কিন শ্রম আইন নিয়ে আবার নতুন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিন্তু অতীতে শ্রম অধিকারের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করেনি৷ যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের পদক্ষেপের কথা বলছে, তাই নতুন শ্রম আইন নিয়ে বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি আছে৷ নানা ধরনের স্যাংশনের কথা বলা হচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে শ্রম আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত করার ঝুঁকি আছে৷’’

নির্বাচনের পর সংকট বৃদ্ধির আশঙ্কা

বাংলাদেশের ওপর বিদেশি ঋণের চাপ বাড়ছে৷ চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার (১০ হাজার কোটি টাকা) ছুঁয়েছে৷ এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৭৯ বিলিয়ন ডলার৷ বাকি ২১ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত৷ বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণের প্রায় ৮৪ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদী৷ বাকি ১৬ শতাংশ বা ১৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ স্বল্পমেয়াদী৷ এখন ঋণ জিডিপির অনুপাত ৪২.১ শতাংশ৷ গত ১০ বছরেই বিদেশি ঋণ বেশি নেয়া হয়েছে৷ তবে ২০১৭-১৮ অর্থ বছর থেকে বিদেশি ঋণ অনেক বাড়তে থাকে৷ ২০১৮-১৭ অর্থ বছর পর্যন্ত মোট বিদেশি ঋণ ছিল ৪৫.৮১ বিলিয়ন ডলার৷

জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে মোট ১১০ কোটি ১৪ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭২ কোটি ৪৩ লাখ ডলার৷ চলতি অর্থবছরের চার মাসে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে ৩৭ কোটি ৭২ লাখ ডলার৷
চলতি অর্থ বছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে ৩২৮ কোটি ডলার শোধ করতে হবে৷ আগের অর্থ বছরে শোধ করতে হয়েছে ২৭৪ কোটি ডলার৷

ইআরডির তথ্য বলছে, আগামী অর্থ বছরে আসল পরিশোধ করতে হবে ২৯০ কোটি (২.৯ বিলিয়ন) ডলার, যা এর পরের অর্থবছরে বেড়ে হবে ৩৩১ কোটি ডলার৷ ২০২৭ সাল নাগাদ এটা ৫০০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে৷

বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে, ‘‘নির্বাচনের আগে থেকেই আমাদের যে ধরনের অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে এর পিছনে আছে অর্থনীতির নীতির জায়গায় দুর্বলতা বা ভুল অর্থনৈতিক নীতির কারণে হয়েছে৷ অবশ্য এর সঙ্গে বৈশ্বিক কারণও আছে৷ এখন যদি নির্বাচনের পরেও একই অর্থনৈতিক নীতি অব্যাহত থাকে, তাহলে আমাদের বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ার পাশাপাশি সক্ষমতা কমে আসবে৷ এটা একটা সংকট সৃষ্টি করবে৷ আমাদের রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স যদি না বাড়ে, তাহলে ঋণ পরিশোধের চাপ সামলানো কঠিন হবে৷ আর সেই অবস্থায় যদি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসে, আহলে আমাদের রপ্তানি আয় আরো কমে যাবে৷ রিজার্ভ পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা অতীতে দেখেছি, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন সব সময়ই অর্থনীতির জন্য ভালো হয়৷ কিন্তু এবার যেভাবে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানে নির্বাচনের পর সবাই অনিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছেন৷ ফলে নির্বাচনের পর অর্থনীতির জন্য সুখবরের পরিবর্তে এখন যে চাপ আছে, তা আরো প্রলম্বিত হতে পারে৷’’

আর সিরডাপের পরিচালক অর্থনীতিবিদ অধাপক ড. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো যারা একটি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে, তাদের হয়ত আরো উদ্দেশ্য আছে৷ তাদের কথায় যে ফেয়ারনেসটা বাংলাদেশের ব্যাপারে দেখতে পাচ্ছি, সেটা কিন্তু ইসরায়েল ও হামাসকেন্দ্রিক ঘটনায় দেখতে পাচ্ছি না৷ আমরা যে ইস্যুগুলো পলিটিক্যালি দেখছি এবং যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কথা শুনছি এর সঙ্গে তো রাজনৈতিক বিষয় আছে৷ তাই যারা ক্ষমতায় আছে, তারা আবার ক্ষমতায় আসলে সেখানে অর্থনেতিক নিষেধাজ্ঞা চলে আসতে পারে৷ যদি সেটা না হয়ে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও কিছুটা সুষ্ঠু হয়, তখন হয়ত ওই পরিস্থিতি না-ও হতে পারে৷’’

তার কথা, ‘‘এখন রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে এমনিতেই অর্থনীতি চাপের মুখে আছে৷ যে ধরনের নির্বাচনের দিকে আমরা যাচ্ছি, তাতে অর্থনীতি আরো চাপে পড়তে পারে।

Facebook Comments Box
ট্যাগস :

নির্বাচনের পরের অর্থনীতি নিয়ে যত শঙ্কা

আপডেট সময় : ০১:৩০:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৩
বাংলাদেশ এখন বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপের মুখে পড়ছে৷ কমছে রিজার্ভ, বাড়ছে ডলার সংকট৷ রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সেও ভাটার টান৷

আগামী ৭ জানুয়াারি বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন৷ ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন ছিল৷ ৩০০ আসনের নির্বাচনে দুই হাজার ৭৪১ জন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন ৷ প্রতি আসনে লড়তে চাচ্ছেন গড়ে ৯ জনেরও বেশি প্রার্থী৷ নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০ টি দল নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে৷ তবে সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ আরো কিছু দল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না৷

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে নির্বাচন নিয়ে একটি বৈরি পরিস্থিতি চলছে৷ আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ আছে৷ কিন্তু তার মধ্যেও দেশ একপাক্ষিক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে৷ এই পরিস্থিতির কারণে সরকারের অর্থনীতির দিকে যে নজর দেয়ার দরকার৷ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী গত বুধবার বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ আরো কমে ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে৷ বুধবারের আগে তা ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার ছিল৷ তবে দায়হীন বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলার৷

২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়৷ তা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ৷ এরপর থেকেই রিজার্ভের ‘ক্ষয়’ শুরু হয়৷ গত দুই বছর ধরে প্রতি মাসে গড়ে এক বিলিয়ন ডলার করে রিজার্ভ কমেছে৷ আমদানি কমার পরও জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ডলার ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯৩ কোটি ডলার৷ ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় থামানো যাচ্ছে না৷ অন্যদিকে রপ্তানি আয় কমছে৷

অক্টোবর মাসে ৩৭৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা ২৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩.৬৪ শতাংশ কম৷ তবে আগের মাস সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে৷ তার আগের দুই মাস জুলাই ও আগস্টে রপ্তানি বেড়েছিল যথাক্রমে ১৫ ও ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ৷

প্রবাসী আয় কয়েক মাস কমে আবার বাড়া শুরু করেছে৷ নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধে প্রবাসী আয় বেড়েছে৷ প্রথম ১৫ দিনে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি৷ গত বছর একই সময়ে এসেছিল ৯২ কোটি ডলার৷ কিন্তু এর ইতিবাচক প্রভাব  রিজার্ভে পড়ছে না৷

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয় (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘যে অর্থনেতিক সংস্কারগুলো দীর্ঘদিন ধরে করা দরকার ছিল, সেগুলো আরো পিছিয়ে নির্বাচনের পরে করার কথা বলা হচ্ছে৷ এটা কোনো সঠিক চিন্তা নয়, কারণ, আমাদের অর্থনৈতিক সংকটের এখন যা ধরন, সেটা দূর করতে পদক্ষেপ নিতে আমরা যদি আরো দেরি করি, তাতে সংকট আরো গভীর হবে৷’’

তার কথা, ‘‘মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভের পতন যদি ঠেকানো না যায়, তাহলে সংকট আরো বাড়বে৷ এটার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যাপক সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক ঐক্যমত দরকার, সেটার কোনো লক্ষণ আমি দেখছি না৷’’

‘আমি আগেও বলেছি, বিদেশি ঋণে যেসব মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে, তার রিভিউ প্রয়োজন৷ এর প্রয়োজনীয়তার দিক বিবেচনা করে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা প্রয়োজন৷ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি যেগুলো জরুরি নয় সেগুলো বাস্তবায়নের বাইরে রাখা উচিত৷ প্রতি বছরই আমাদের বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে৷ আর এটা শোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায় (ডলারে)৷ আর এজন্য রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই৷ আমাদের দেখতে হবে যে প্রকল্পগুলো আছে, সেগুলো রপ্তানি উন্নয়নে ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কতটা কাজে লাগবে,’’ বলেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান৷

তার কথা, ‘‘মার্কিন শ্রম আইন নিয়ে আবার নতুন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিন্তু অতীতে শ্রম অধিকারের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করেনি৷ যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের পদক্ষেপের কথা বলছে, তাই নতুন শ্রম আইন নিয়ে বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি আছে৷ নানা ধরনের স্যাংশনের কথা বলা হচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে শ্রম আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত করার ঝুঁকি আছে৷’’

নির্বাচনের পর সংকট বৃদ্ধির আশঙ্কা

বাংলাদেশের ওপর বিদেশি ঋণের চাপ বাড়ছে৷ চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার (১০ হাজার কোটি টাকা) ছুঁয়েছে৷ এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৭৯ বিলিয়ন ডলার৷ বাকি ২১ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত৷ বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণের প্রায় ৮৪ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদী৷ বাকি ১৬ শতাংশ বা ১৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ স্বল্পমেয়াদী৷ এখন ঋণ জিডিপির অনুপাত ৪২.১ শতাংশ৷ গত ১০ বছরেই বিদেশি ঋণ বেশি নেয়া হয়েছে৷ তবে ২০১৭-১৮ অর্থ বছর থেকে বিদেশি ঋণ অনেক বাড়তে থাকে৷ ২০১৮-১৭ অর্থ বছর পর্যন্ত মোট বিদেশি ঋণ ছিল ৪৫.৮১ বিলিয়ন ডলার৷

জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে মোট ১১০ কোটি ১৪ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭২ কোটি ৪৩ লাখ ডলার৷ চলতি অর্থবছরের চার মাসে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে ৩৭ কোটি ৭২ লাখ ডলার৷
চলতি অর্থ বছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে ৩২৮ কোটি ডলার শোধ করতে হবে৷ আগের অর্থ বছরে শোধ করতে হয়েছে ২৭৪ কোটি ডলার৷

ইআরডির তথ্য বলছে, আগামী অর্থ বছরে আসল পরিশোধ করতে হবে ২৯০ কোটি (২.৯ বিলিয়ন) ডলার, যা এর পরের অর্থবছরে বেড়ে হবে ৩৩১ কোটি ডলার৷ ২০২৭ সাল নাগাদ এটা ৫০০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে৷

বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে, ‘‘নির্বাচনের আগে থেকেই আমাদের যে ধরনের অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে এর পিছনে আছে অর্থনীতির নীতির জায়গায় দুর্বলতা বা ভুল অর্থনৈতিক নীতির কারণে হয়েছে৷ অবশ্য এর সঙ্গে বৈশ্বিক কারণও আছে৷ এখন যদি নির্বাচনের পরেও একই অর্থনৈতিক নীতি অব্যাহত থাকে, তাহলে আমাদের বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ার পাশাপাশি সক্ষমতা কমে আসবে৷ এটা একটা সংকট সৃষ্টি করবে৷ আমাদের রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স যদি না বাড়ে, তাহলে ঋণ পরিশোধের চাপ সামলানো কঠিন হবে৷ আর সেই অবস্থায় যদি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসে, আহলে আমাদের রপ্তানি আয় আরো কমে যাবে৷ রিজার্ভ পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা অতীতে দেখেছি, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন সব সময়ই অর্থনীতির জন্য ভালো হয়৷ কিন্তু এবার যেভাবে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানে নির্বাচনের পর সবাই অনিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছেন৷ ফলে নির্বাচনের পর অর্থনীতির জন্য সুখবরের পরিবর্তে এখন যে চাপ আছে, তা আরো প্রলম্বিত হতে পারে৷’’

আর সিরডাপের পরিচালক অর্থনীতিবিদ অধাপক ড. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো যারা একটি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে, তাদের হয়ত আরো উদ্দেশ্য আছে৷ তাদের কথায় যে ফেয়ারনেসটা বাংলাদেশের ব্যাপারে দেখতে পাচ্ছি, সেটা কিন্তু ইসরায়েল ও হামাসকেন্দ্রিক ঘটনায় দেখতে পাচ্ছি না৷ আমরা যে ইস্যুগুলো পলিটিক্যালি দেখছি এবং যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কথা শুনছি এর সঙ্গে তো রাজনৈতিক বিষয় আছে৷ তাই যারা ক্ষমতায় আছে, তারা আবার ক্ষমতায় আসলে সেখানে অর্থনেতিক নিষেধাজ্ঞা চলে আসতে পারে৷ যদি সেটা না হয়ে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও কিছুটা সুষ্ঠু হয়, তখন হয়ত ওই পরিস্থিতি না-ও হতে পারে৷’’

তার কথা, ‘‘এখন রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে এমনিতেই অর্থনীতি চাপের মুখে আছে৷ যে ধরনের নির্বাচনের দিকে আমরা যাচ্ছি, তাতে অর্থনীতি আরো চাপে পড়তে পারে।

Facebook Comments Box