ঢাকা ০৫:৩৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

ডলারের বাজার অস্থির

সারাবেলা সংবাদ ডেস্ক :
  • আপডেট সময় : ০৯:৩৮:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৩ ৬২ বার পঠিত

বাংলাদেশে গত দুই সপ্তাহ ধরে অস্থিরতা ডলারের বাজারে। প্রণোদনাসহ সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা দরে প্রবাসী আয় কেনার নির্দেশনা থাকলেও অনেক ব্যাংক এমনকি ১২৪ টাকা দরেও ডলার কিনেছে বলে অভিযোগ ওঠে।

যদিও আমদানিতে এসব ডলার বিক্রির কথা ১১১টাকা দরে। এছাড়া খোলাবাজারেও ডলারের দাম ১শ ২৭ টাকা পর্যন্ত উঠতে দেখা গেছে। কেন এমন পরিস্থিতি?

ঢাকার একজন খাদ্য আমদানিকারক আনোয়ার হোসেন। আমদানির জন্য বিভিন্ন সময় ব্যাংকে এলসি খুলতে হয় তাকে।

আনোয়ার হোসেন জানাচ্ছেন, সম্প্রতি একটি ব্যাংকে এলসি খুলতে গেলে তার কাছে সরকারি রেট ১১১ টাকার বদলে ডলারের দাম ধরা হয় ১২৫ টাকা। মি. হোসেন বলছিলেন, এই বাড়তি দামের কোন কারণ জানাতে পারেনি ব্যাংক।

“আমি আপনাকে ব্যাংকের নাম বলতে পারবো না। কারণ তাহলে যেটুকু এলসি পাচ্ছি, সেটাও আমি পাবো না। কিন্তু তারা ১২৫ টাকা করে আমার কাছে জমা রেখেছে”

“আমি বললাম, এক সপ্তাহ আগেই আপনারা আমার কাছ থেকে ডলার প্রতি ১১৫ টাকা করে জমা রেখেছেন। এখন কেন ১২৫ টাকা রাখবেন? সরকার তো ডলারের মূল্য বৃদ্ধি করে নাই। তখন ওরা বললো যে, আপনাকে ১২৫ টাকা করেই দিতে হবে। না হলে এলসি করা যাবে না,” বলেন আনোয়ার হোসেন।

এই আমদানিকারক ব্যাংকে ডলারের বাড়তি দাম নিয়ে যে অবস্থায় পড়েছেন, সেটাই যেন এখন ডলার মার্কেটের বাস্তবতা। কিন্তু ডলারের খোলা বাজারের অবস্থা কী?

খোলাবাজারে যা দেখা গেল:
খোলা বাজারের পরিস্থিতি বুঝতে গত সোমবার ঢাকায় কালোবাজারে ডলার বিক্রির একটা পরিচিত স্পটে যান এ সংবাদদাতা। পরিচয় গোপন করে ডলার কেনার চেষ্টা করা হয়।

এই সংবাদদাতা প্রথমেই যে মানি এক্সচেঞ্জে যান , সেখান থেকে জানানো হলো ডলার নেই। কোন এনডোর্স করা যাবে না।

কিন্তু যখন শুধু ডলার কিনতে চান তিনি, তখন পাশেই থাকা একজন বললেন – ডলারপ্রতি ১২৭ টাকা করে দিতে হবে। এর কমে বিক্রি করতে রাজি হননি তিনি।

শেষ পর্যন্ত ১২৭ টাকা দরেই ডলার কিনতে হলো। এরপর ঢাকার মতিঝিল, গুলশান, পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকায় ৫টি মানি এক্সচেঞ্জে গিয়ে দেখা গেল, ডলারের রেট অনেকটা একইরকম – ১২৫ থেকে ১২৭ টাকা চাওয়া হচ্ছে, অর্থাৎ কেউই নির্ধারিত দামে ডলার বিক্রি করছেন না।

এর কারণ জানতে চাইলে সামাদ (ছদ্মনাম) নামে একজন বললেন, বাজারে ডলার নেই। ব্যাংকগুলোই বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। সুতরাং খোলাবাজারে তারা বেশি দামে ডলার না কিনলে ডলার পাবেন না। ফলে বেশি দামে কিনে আরো বেশি দামে বিক্রি করছেন তারা।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী মানি এক্সচেঞ্জগুলো ডলার বিক্রি করতে পারবে সর্বোচ্চ ১১৭ টাকা দরে। সেক্ষেত্রে এর চেয়ে কম দামে তাদের ডলার কিনতে হবে। কিন্তু মানি চেঞ্জারগুলো এ দর মানছে না – এমন অভিযোগ ওঠার পর বাংলাদেশ ব্যাংক নজরদারি বৃদ্ধি করে।

কিন্তু যেসব মানি এক্সচেঞ্জ নির্ধারিত দামে ডলার ক্রয়-বিক্রয় করছেন, তারা বলছেন, তাদের কাছে কেউ সেভাবে ডলার বিক্রি করতেই আসছেন না।

ঢাকার পল্টনে মেক্সিমকো মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন বলছেন, যারা বিদেশ থেকে আসার সময় ডলার নিয়ে আসেন, তাদের কাছ থেকেই তারা ডলার কিনে থাকেন। এটাই তাদের মূল উৎস। কিন্তু যেহেতু কালোবাজারে ডলারের দাম বেশি, সেহেতু বেশিরভাগ প্রবাসী সেখানেই ডলার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

“গভর্নমেন্ট রেট তো কম, সুতরাং প্রবাসীরা কেন আমাদের কাছে ডলার বেচবে? তাছাড়া এখন সরকারি নজরদারি অনেক কড়া”

“কেউ যদি ডলারের বৈধ কাগজ দেখাতে না পারে, আমরা সেটা কিনতে পারবো না। কিনলে প্রশাসন ধরবে। ফলে এই ডলারগুলোও আমরা পাচ্ছি না। এগুলোও ব্ল্যাক মার্কেটে চলে যাচ্ছে,” বলেন মোশাররফ হোসেন।

তার মতে, এসব কারণেই যারা শিক্ষা, চিকিৎসা বা ভ্রমণের জন্য যারা বিদেশ যাবেন তারা চাহিদা মতো ডলার পাচ্ছেন না। কারণ মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে ডলারের ঘাটতি আছে।

“বাধ্য হয়ে এসব লোক যখন ব্ল্যাক মার্কেটে যাচ্ছে, তখন চাহিদা বেড়ে ডলারের দামও সেখানে বাড়ছে,” জানান মোশাররফ হোসেন।

পরিস্থিতি কেন এমন হলো:
বাংলাদেশে ডলারের দাম বাড়তে থাকে ২০২১ সালের ২২শে অগাস্ট থেকে। তখন ডলারের দাম ৮৪ টাকা থেকে ৮৫ তে উঠে আসে। দুই বছরের ব্যবধানে সেটা হয়ে যায় ১০৯ টাকায়। বর্তমানে যেটা ১১১ টাকা।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই দাম খোলাবাজারে কার্যকর হয়নি। দুই বছর আগে একবার দাম বৃদ্ধি শুরুর পর বর্তমানে সেটা ১২৫ থেকে ১২৭ টাকায় ওঠা-নামা করছে।

এসময় ডলারের দাম বাজারের উপর ছেড়ে দেয়ার দাবি উঠলে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এর দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স এবিবিকে।

কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাফেদা-এবিবির নির্ধারণ করা রেটও খোলাবাজারে কার্যকর থাকেনি।

বেশ কিছু ব্যাংক নির্ধারিত দরের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিদেশি রেমিটেন্স হাউস থেকে ডলার কিনে সেটা আরো বেশি দামে গ্রাহকদের কাছে দিয়েছে।

জানতে চাইলে এবিবির সাবেক সভাপতি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বিবিসিকে বলেন, এরকম ঘটনা তারাও শুনেছেন এবং এটাই বাস্তবতা যে ব্যাংকগুলো বেশি দামে ক্রয়-বিক্রয় করছে।

কিন্তু কেন এ এরকম হচ্ছে? মাহবুবুর রহমান জানান, ব্যবসায়ীদের কাছে ডলারের রেট গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং এলসি খুলে ব্যবসা করার ওপর ব্যবসায়ীরা জোর দিচ্ছেন। সেজন্য ব্যবসায়ীদের চাহিদা মেটাতেই ব্যাংকগুলোকে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে ,যেহেতু ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত ডলার নেই।

“আমার কাছে গ্রাহক খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমি যদি ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ী এলসি দিতে না পারি, তাহলে সে ক্লায়েন্ট অন্য ব্যাংকে চলে যাবে। এখন কোন ব্যাংক তো এভাবে নিজেকে ক্ষতির মুখে ফেলবে না। সে বেশি দাম দিয়ে হলেও ডলার কিনে ব্যবসা এবং ক্লায়েন্ট ধরে রাখবে,” বলেন মাহবুবুর রহমান।

বাফেদা-এবিবি বলছে ১১১ টাকায় এলসি সেটেলমেন্ট করতে। এ দামে ডলার বিক্রি করতে হলে এর চেয়ে কম দামে ডলার ক্রয় করতে হবে। কিন্তু সে দাম দিয়ে ডলার ক্রয় করা যাচ্ছে না বলে ব্যাংকাররা জানান। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকও তার রিজার্ভ থেকে এতো ডলার বিক্রি করে চাহিদা মেটাতে পারবে না।

মাহবুবুর রহমান প্রশ্ন তোলেন, যেসব ব্যাংক ১১৮ টাকা বা তার চেয়ে বেশি দামে বিদেশি রেমিটেন্স হাউস থেকে ডলার কিনে ব্যবসায়ীদের এলসি দিচ্ছে, সে কিভাবে ১১১ টাকা দরে এটা দেবে?

“দিনশেষে ব্যাংক তো একটা কমার্শিয়াল অরগানাইজেশন। এখানে তো কেউ চ্যারিটি করতে বসেনি,” বলছিলেন ড. জাহিদ হোসেন।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ডলারের বাজারে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে হুন্ডি। যারা বিদেশে ডলার নিয়ে যাচ্ছেন, তারা বেশি দাম দিয়ে হলেও ডলার কিনতে চান। এটা বাজারে চাহিদা তৈরি করছে। ফলে বিদেশি রেমিটিং হাউসগুলো তাদের কাছে বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে।

কিন্তু বাজারে এমন অবস্থা কেন হলো? এজন্য ঘুরে-ফিরে একই প্রসঙ্গ বারবার সামনে আসছে। সেটি হচ্ছে – বাংলাদেশের নিম্নমুখী রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী আয়ের কারণে ডলার সংকটের কথা।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দায়ী করছেন, সংকটের মধ্যেও ডলারকে বাজারমুখী না করে একে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাকে।

“এখানে ডলারের দাম নির্ধারণের যে মডেল, সেটা দিয়ে ডলার বাজার স্বাভাবিক রাখা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক একেক সময় একেক পলিসি নিচ্ছে। ফলে যারা কারসাজি করে, তারাও এটার সুযোগ নিচ্ছে। বাজারদর অনুযায়ী দাম নির্ধারণ না হলে এটার সংকট মিটবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ড. জাহিদ হোসেন।

বাংলাদেশে নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। এই সময়ের মধ্যে সরকারের মূদ্রানীতি কিংবা ডলার বাজার নিয়ে নীতিতে বড় ধরণের পরিবর্তনের সম্ভাবনাও দেখছেন না অনেকেই।

ফলে ডলারের যে উর্দ্ধমুখী দাম, সেটা নির্বাচনে আগে কতটা স্থিতিশীল হবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই।

“আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে, যেখানে আমাদের যোগানের অভাব আছে সেখানে আগামীতে ডলারের দাম কমার কোন সম্ভাবনা নাই। কারণ এটাতো বাজারের উপর নির্ভর করছে না। এটাকে সেভাবে রাখা হয়নি,” বলেন ড. জাহিদ হোসেন।

কিন্তু এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কী ভাবছে? জানতে চাইলে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

যদিও ব্যাংকসূত্র জানিয়েছে, ডলারের বাজারে কারসাজি রোধ করতে ইতোমধ্যেই কিছু পদক্ষেপ তারা নিয়েছেন, যার প্রভাবে হয়তো ‘শিগগিরই বাজারে দাম কমে’ আসবে।

কিন্তু বাংলাদেশে যখন গত দুই বছর ধরেই ডলারের প্রধান দুই উৎস রেমিটেন্স ও রফতানি আয় নিম্নমুখী, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে সেটা এক বড় প্রশ্ন। বিবিসি

Facebook Comments Box
ট্যাগস :

ডলারের বাজার অস্থির

আপডেট সময় : ০৯:৩৮:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশে গত দুই সপ্তাহ ধরে অস্থিরতা ডলারের বাজারে। প্রণোদনাসহ সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা দরে প্রবাসী আয় কেনার নির্দেশনা থাকলেও অনেক ব্যাংক এমনকি ১২৪ টাকা দরেও ডলার কিনেছে বলে অভিযোগ ওঠে।

যদিও আমদানিতে এসব ডলার বিক্রির কথা ১১১টাকা দরে। এছাড়া খোলাবাজারেও ডলারের দাম ১শ ২৭ টাকা পর্যন্ত উঠতে দেখা গেছে। কেন এমন পরিস্থিতি?

ঢাকার একজন খাদ্য আমদানিকারক আনোয়ার হোসেন। আমদানির জন্য বিভিন্ন সময় ব্যাংকে এলসি খুলতে হয় তাকে।

আনোয়ার হোসেন জানাচ্ছেন, সম্প্রতি একটি ব্যাংকে এলসি খুলতে গেলে তার কাছে সরকারি রেট ১১১ টাকার বদলে ডলারের দাম ধরা হয় ১২৫ টাকা। মি. হোসেন বলছিলেন, এই বাড়তি দামের কোন কারণ জানাতে পারেনি ব্যাংক।

“আমি আপনাকে ব্যাংকের নাম বলতে পারবো না। কারণ তাহলে যেটুকু এলসি পাচ্ছি, সেটাও আমি পাবো না। কিন্তু তারা ১২৫ টাকা করে আমার কাছে জমা রেখেছে”

“আমি বললাম, এক সপ্তাহ আগেই আপনারা আমার কাছ থেকে ডলার প্রতি ১১৫ টাকা করে জমা রেখেছেন। এখন কেন ১২৫ টাকা রাখবেন? সরকার তো ডলারের মূল্য বৃদ্ধি করে নাই। তখন ওরা বললো যে, আপনাকে ১২৫ টাকা করেই দিতে হবে। না হলে এলসি করা যাবে না,” বলেন আনোয়ার হোসেন।

এই আমদানিকারক ব্যাংকে ডলারের বাড়তি দাম নিয়ে যে অবস্থায় পড়েছেন, সেটাই যেন এখন ডলার মার্কেটের বাস্তবতা। কিন্তু ডলারের খোলা বাজারের অবস্থা কী?

খোলাবাজারে যা দেখা গেল:
খোলা বাজারের পরিস্থিতি বুঝতে গত সোমবার ঢাকায় কালোবাজারে ডলার বিক্রির একটা পরিচিত স্পটে যান এ সংবাদদাতা। পরিচয় গোপন করে ডলার কেনার চেষ্টা করা হয়।

এই সংবাদদাতা প্রথমেই যে মানি এক্সচেঞ্জে যান , সেখান থেকে জানানো হলো ডলার নেই। কোন এনডোর্স করা যাবে না।

কিন্তু যখন শুধু ডলার কিনতে চান তিনি, তখন পাশেই থাকা একজন বললেন – ডলারপ্রতি ১২৭ টাকা করে দিতে হবে। এর কমে বিক্রি করতে রাজি হননি তিনি।

শেষ পর্যন্ত ১২৭ টাকা দরেই ডলার কিনতে হলো। এরপর ঢাকার মতিঝিল, গুলশান, পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকায় ৫টি মানি এক্সচেঞ্জে গিয়ে দেখা গেল, ডলারের রেট অনেকটা একইরকম – ১২৫ থেকে ১২৭ টাকা চাওয়া হচ্ছে, অর্থাৎ কেউই নির্ধারিত দামে ডলার বিক্রি করছেন না।

এর কারণ জানতে চাইলে সামাদ (ছদ্মনাম) নামে একজন বললেন, বাজারে ডলার নেই। ব্যাংকগুলোই বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। সুতরাং খোলাবাজারে তারা বেশি দামে ডলার না কিনলে ডলার পাবেন না। ফলে বেশি দামে কিনে আরো বেশি দামে বিক্রি করছেন তারা।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী মানি এক্সচেঞ্জগুলো ডলার বিক্রি করতে পারবে সর্বোচ্চ ১১৭ টাকা দরে। সেক্ষেত্রে এর চেয়ে কম দামে তাদের ডলার কিনতে হবে। কিন্তু মানি চেঞ্জারগুলো এ দর মানছে না – এমন অভিযোগ ওঠার পর বাংলাদেশ ব্যাংক নজরদারি বৃদ্ধি করে।

কিন্তু যেসব মানি এক্সচেঞ্জ নির্ধারিত দামে ডলার ক্রয়-বিক্রয় করছেন, তারা বলছেন, তাদের কাছে কেউ সেভাবে ডলার বিক্রি করতেই আসছেন না।

ঢাকার পল্টনে মেক্সিমকো মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন বলছেন, যারা বিদেশ থেকে আসার সময় ডলার নিয়ে আসেন, তাদের কাছ থেকেই তারা ডলার কিনে থাকেন। এটাই তাদের মূল উৎস। কিন্তু যেহেতু কালোবাজারে ডলারের দাম বেশি, সেহেতু বেশিরভাগ প্রবাসী সেখানেই ডলার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

“গভর্নমেন্ট রেট তো কম, সুতরাং প্রবাসীরা কেন আমাদের কাছে ডলার বেচবে? তাছাড়া এখন সরকারি নজরদারি অনেক কড়া”

“কেউ যদি ডলারের বৈধ কাগজ দেখাতে না পারে, আমরা সেটা কিনতে পারবো না। কিনলে প্রশাসন ধরবে। ফলে এই ডলারগুলোও আমরা পাচ্ছি না। এগুলোও ব্ল্যাক মার্কেটে চলে যাচ্ছে,” বলেন মোশাররফ হোসেন।

তার মতে, এসব কারণেই যারা শিক্ষা, চিকিৎসা বা ভ্রমণের জন্য যারা বিদেশ যাবেন তারা চাহিদা মতো ডলার পাচ্ছেন না। কারণ মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে ডলারের ঘাটতি আছে।

“বাধ্য হয়ে এসব লোক যখন ব্ল্যাক মার্কেটে যাচ্ছে, তখন চাহিদা বেড়ে ডলারের দামও সেখানে বাড়ছে,” জানান মোশাররফ হোসেন।

পরিস্থিতি কেন এমন হলো:
বাংলাদেশে ডলারের দাম বাড়তে থাকে ২০২১ সালের ২২শে অগাস্ট থেকে। তখন ডলারের দাম ৮৪ টাকা থেকে ৮৫ তে উঠে আসে। দুই বছরের ব্যবধানে সেটা হয়ে যায় ১০৯ টাকায়। বর্তমানে যেটা ১১১ টাকা।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই দাম খোলাবাজারে কার্যকর হয়নি। দুই বছর আগে একবার দাম বৃদ্ধি শুরুর পর বর্তমানে সেটা ১২৫ থেকে ১২৭ টাকায় ওঠা-নামা করছে।

এসময় ডলারের দাম বাজারের উপর ছেড়ে দেয়ার দাবি উঠলে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এর দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স এবিবিকে।

কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাফেদা-এবিবির নির্ধারণ করা রেটও খোলাবাজারে কার্যকর থাকেনি।

বেশ কিছু ব্যাংক নির্ধারিত দরের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিদেশি রেমিটেন্স হাউস থেকে ডলার কিনে সেটা আরো বেশি দামে গ্রাহকদের কাছে দিয়েছে।

জানতে চাইলে এবিবির সাবেক সভাপতি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বিবিসিকে বলেন, এরকম ঘটনা তারাও শুনেছেন এবং এটাই বাস্তবতা যে ব্যাংকগুলো বেশি দামে ক্রয়-বিক্রয় করছে।

কিন্তু কেন এ এরকম হচ্ছে? মাহবুবুর রহমান জানান, ব্যবসায়ীদের কাছে ডলারের রেট গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং এলসি খুলে ব্যবসা করার ওপর ব্যবসায়ীরা জোর দিচ্ছেন। সেজন্য ব্যবসায়ীদের চাহিদা মেটাতেই ব্যাংকগুলোকে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে ,যেহেতু ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত ডলার নেই।

“আমার কাছে গ্রাহক খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমি যদি ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ী এলসি দিতে না পারি, তাহলে সে ক্লায়েন্ট অন্য ব্যাংকে চলে যাবে। এখন কোন ব্যাংক তো এভাবে নিজেকে ক্ষতির মুখে ফেলবে না। সে বেশি দাম দিয়ে হলেও ডলার কিনে ব্যবসা এবং ক্লায়েন্ট ধরে রাখবে,” বলেন মাহবুবুর রহমান।

বাফেদা-এবিবি বলছে ১১১ টাকায় এলসি সেটেলমেন্ট করতে। এ দামে ডলার বিক্রি করতে হলে এর চেয়ে কম দামে ডলার ক্রয় করতে হবে। কিন্তু সে দাম দিয়ে ডলার ক্রয় করা যাচ্ছে না বলে ব্যাংকাররা জানান। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকও তার রিজার্ভ থেকে এতো ডলার বিক্রি করে চাহিদা মেটাতে পারবে না।

মাহবুবুর রহমান প্রশ্ন তোলেন, যেসব ব্যাংক ১১৮ টাকা বা তার চেয়ে বেশি দামে বিদেশি রেমিটেন্স হাউস থেকে ডলার কিনে ব্যবসায়ীদের এলসি দিচ্ছে, সে কিভাবে ১১১ টাকা দরে এটা দেবে?

“দিনশেষে ব্যাংক তো একটা কমার্শিয়াল অরগানাইজেশন। এখানে তো কেউ চ্যারিটি করতে বসেনি,” বলছিলেন ড. জাহিদ হোসেন।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ডলারের বাজারে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে হুন্ডি। যারা বিদেশে ডলার নিয়ে যাচ্ছেন, তারা বেশি দাম দিয়ে হলেও ডলার কিনতে চান। এটা বাজারে চাহিদা তৈরি করছে। ফলে বিদেশি রেমিটিং হাউসগুলো তাদের কাছে বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে।

কিন্তু বাজারে এমন অবস্থা কেন হলো? এজন্য ঘুরে-ফিরে একই প্রসঙ্গ বারবার সামনে আসছে। সেটি হচ্ছে – বাংলাদেশের নিম্নমুখী রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী আয়ের কারণে ডলার সংকটের কথা।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দায়ী করছেন, সংকটের মধ্যেও ডলারকে বাজারমুখী না করে একে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাকে।

“এখানে ডলারের দাম নির্ধারণের যে মডেল, সেটা দিয়ে ডলার বাজার স্বাভাবিক রাখা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক একেক সময় একেক পলিসি নিচ্ছে। ফলে যারা কারসাজি করে, তারাও এটার সুযোগ নিচ্ছে। বাজারদর অনুযায়ী দাম নির্ধারণ না হলে এটার সংকট মিটবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ড. জাহিদ হোসেন।

বাংলাদেশে নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। এই সময়ের মধ্যে সরকারের মূদ্রানীতি কিংবা ডলার বাজার নিয়ে নীতিতে বড় ধরণের পরিবর্তনের সম্ভাবনাও দেখছেন না অনেকেই।

ফলে ডলারের যে উর্দ্ধমুখী দাম, সেটা নির্বাচনে আগে কতটা স্থিতিশীল হবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই।

“আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে, যেখানে আমাদের যোগানের অভাব আছে সেখানে আগামীতে ডলারের দাম কমার কোন সম্ভাবনা নাই। কারণ এটাতো বাজারের উপর নির্ভর করছে না। এটাকে সেভাবে রাখা হয়নি,” বলেন ড. জাহিদ হোসেন।

কিন্তু এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কী ভাবছে? জানতে চাইলে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

যদিও ব্যাংকসূত্র জানিয়েছে, ডলারের বাজারে কারসাজি রোধ করতে ইতোমধ্যেই কিছু পদক্ষেপ তারা নিয়েছেন, যার প্রভাবে হয়তো ‘শিগগিরই বাজারে দাম কমে’ আসবে।

কিন্তু বাংলাদেশে যখন গত দুই বছর ধরেই ডলারের প্রধান দুই উৎস রেমিটেন্স ও রফতানি আয় নিম্নমুখী, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে সেটা এক বড় প্রশ্ন। বিবিসি

Facebook Comments Box