শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র – কতটা গুরুত্ব বহন করে?
- আপডেট সময় : ১২:৪০:২৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৪৮ বার পঠিত
তীব্র গণআন্দোলনের মুখে গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারত যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন কি না, তা নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনার একটি ফোন রেকর্ড ফাঁসের ও কথিত ‘পদত্যাগপত্র’ ঘিরেই নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে।
যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে সেই পদত্যাগপত্রটি ভুয়া বলে দাবি করা হয়েছে।
যদিও এর আগের দিন দলীয় এক কর্মীর সাথে কথপোকথনের একটি অডিও কল রেকর্ডে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায় দেশ ছাড়ার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন নি।
গত মাসে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরদিন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদও গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন তার মা পদত্যাগ করেন নি।
যদিও শেখ হাসিনা পতনের দিনই রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন।
শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ছয়ই অগাস্ট সেদেশের পার্লামেন্টে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি বলেছিলেন, ”আমাদের জানা মতে নিরাপত্তা বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকের পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন।”
পরবর্তীতে তিনি শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ বিশেষণ ব্যবহার করেছেন।
কিন্তু নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন কী, করেন নি সেটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেই নিয়েও নানা আলোচনা চলছে সবখানে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে কোন সরকার প্রধানই ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করেন না।
এখন প্রশ্ন উঠেছে শেখ হাসিনা যদি সত্যিই পদত্যাগপত্র জমা না দেন, ভবিষ্যতে এটি নিয়ে কোন সংকট তৈরি হতে পারে কী না?
শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে ধোঁয়াশা কেন?
গত ৫ই অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরই ওইদিন বিকেলে দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
এসময় তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও পদত্যাগ করেছেন। এখন একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবো”।
তবে, সেনাপ্রধানের বক্তব্যের আগেই ওইদিন দুপুরের পরই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন ও তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকে নিরাপত্তা তুলে নেয়া হয়।
তখন অনেক মানুষকে গণভবন, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ও সংসদ ভবনে ঢুকে উল্লাস করতে দেখা গিয়েছিলো।
ওই দিন রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছিলেন, “আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এবং আমি তা গ্রহণ করেছি”।
পরদিন ছয়ই অগাস্ট রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করার কথা জানানো হয়।
দুই দিন পর গত আটই অগাস্ট শপথ নেয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এরপর দিন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে তার মা পদত্যাগ করেন নি।
সেখানে তিনি বলেন, ‘মা কখনই আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি। কারণ তিনি সে সময় পাননি।’
সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে শুরু করে। সময় ছিল না। তিনি ব্যাগ গোছানোর সময়টুকুও পাননি। যতদূর জানি, সংবিধান অনুযায়ী তিনি এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।’
গণমাধ্যমে দেয়া জয়ের ওই বক্তব্যের কারণেই বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়।
অডিও রের্কড ও ‘পদত্যাগপত্র’ গুঞ্জন
গত সপ্তাহে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক আওয়ামী লীগ কর্মীর সাথে শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপের অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ফাঁস হওয়া অডিওতে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, “আমি তো পদত্যাগ করি নাই। আমাদের সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যেভাবে পদত্যাগ করতে হয় আমার কিন্তু সেভাবে পদত্যাগ করা হয় নি”।
তখন তিনি আরো বলেন, “বঙ্গভবনে গিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা আমি দেই নাই। কাজেই আমার পদত্যাগ হয় নি। আমি এখনো বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী”।
মূলত এই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরই এ নিয়ে নানা আলোচনা তৈরি হয়।
কেননা, ওই অডিও রেকর্ডে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায় তিনি যেকোনো সময় বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারেন।
যদিও স্বতন্ত্রভাবে ওই অডিও রেকর্ডটি যাচাই করার সুযোগ হয়নি।
এরপর দিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ‘পদত্যাগপত্রের’ ছবি ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও খবর প্রকাশিত হয়।
ওই কাগজটিতে শেখ হাসিনার স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছিল। যার শেষে লেখা ছিল, “প্রাণহানি এড়ানোর জন্য আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করছি”।
তবে, এই ‘পদত্যাগপত্র’-কে ভুয়া বলে দাবি করেছে আওয়ামী লীগ। সোমবার আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে শেখ হাসিনার পদত্যাগসংক্রান্ত পত্রটি ভুয়া দাবি করে দলটি।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের নিয়ম কি?
বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৭ ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হওয়ার জন্য যে শর্তাবলী আছে সেগুলোর মধ্যে দুটি হলো রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগ জমা দেওয়া আর সংসদ সদস্য পদে না থাকা।
গত ৫ই অগাস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণ অনুযায়ী, তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন এবং এর পরের দিন তিনি দ্বাদশ সংসদ ভেঙ্গে দিয়েছেন।
আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ কাজী জাহেদ ইকবাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যদি তর্কের খাতিরেও ধরে নেই শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি, তবে এই বিষয়টি তো স্টেট নেসেসিটি থিউরিতে চলে গেছে”।
সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, একজন প্রধানমন্ত্রী আরেকজন প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যাবেন।
মি. ইকবাল বলেন, “উনি তো কারো কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের অপেক্ষা করেন নি। তিনি তো দেশ ছেড়ে গেছেন। এরপর রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছে। সংসদ ভাঙার পর ওনার তো প্রধানমন্ত্রীত্ব করার আর কোন সুযোগ থাকে না”।
এই বিষয়টি নিয়ে প্রথম ধোঁয়াশা তৈরি হয় গত মাসে শেখ হাসিনা পুত্র জয়ের বক্তব্যের জের ধরে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থান বা যুদ্ধ মুহূর্তে পদত্যাগের অর্থ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলে ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করা না। সংবিধানেও সেটা বলা নেই।
সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নতুন একটা সরকার গঠনের এক মাস পরে এসে এই প্রশ্ন গুরুত্ব বহন করে না শেখ হাসিনা পদত্যাগ সঠিকভাবে হয়েছে কী না”।
“প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র দিছে কী দেন নাই, এটা বলার একমাত্র এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। তিনি যেহেতু ওই দিনই বলেছেন শেখ হাসিনা তার কাছে পদত্যাগপত্র দিয়েছেন, সুতরাং এখন অস্বীকার করলেও পদত্যাগ কার্যকর হতে কোন বাঁধা নেই”, বলছিলেন মি. পান্না।
সাংবিধানিক সংকট হবে কী না?
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলে কোন সরকার ব্যবস্থার কথা বলা নেই। পাঁচই অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানে বলা না থাকলেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান এক ধরনের কর্তৃত্ব নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির আদেশে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সংবিধানে এমন কোনো বিধি নেই।
সংবিধানে না থাকলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে শপথ অনুষ্ঠানের আগে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের মতামত চেয়েছিলেন কোর্টের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন। সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে সুপ্রিম কোর্ট মতামত দিয়েছে বলে এক বার্তায় জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
তবে আইন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন ভবিষ্যতে কখনো পরিস্থিতি ও সুযোগ তৈরি হলে আদালতে বিষয়টি উঠতেও পারে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শেখ হাসিনা এখন দেশে নাই সত্য। এ কারণে এটি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তা গুরুত্ব পাচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে এ নিয়ে কখনো যে প্রশ্ন উঠতে পারে না তা কিন্তু নয়”।
তবে আইনজীবী মি. ইকবাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে গেলে একটা ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে পরামর্শ চেয়েছেন। সেই পরামর্শ সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে”।
এই আইন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এমন পরিস্থিতিতে আপিল বিভাগের পরামর্শে নতুন সরকার তৈরি হওয়ায় পরবর্তীতে এটি নিয়ে জটিলতা বা সংকট তৈরি হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞরা সবাই মনে করছেন ৫ই অগাস্ট যে বিশেষ পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রী পদ শূন্য হয়েছে ও পরবর্তীতে যে সরকার গঠন হয়েছে সেটি কোন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি।
গণঅভ্যুত্থানের বিশেষ পরিস্থিতিতে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে যারা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করবে, এইসব প্রশ্নের জবাব এড়াতে তারা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারকে বৈধতা দিতে হবে সরকার আগে। তাহলে এ নিয়ে কোন প্রশ্নের সুযোগ থাকবে না ভবিষ্যতে।
২০০৭ সালে সেনা সমথিত সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকাকালে যেসব কাজ করেছে, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর সংসদে বেশিরভাগ কাজের বৈধতা দিয়েছিল।
বিবিসি বাংলা