যেসব কারণে কমছে না খাদ্য পণ্যের দাম
- আপডেট সময় : ১১:৪৮:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ৬১ বার পঠিত
বিশ্ববাজারে সম্প্রতি খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম তো কমেইনি, উল্টে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, অগাস্ট মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.৫৪ শতাংশে। এটি দেশে গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতির এই বিষয়টি শুধু অগাস্ট মাসের বিষয় নয়, বরং গত বছরের মার্চ থেকেই খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে তা আর ঠেকানো যায়নি এবং সেটাই এখন এতো বড় আকার ধারণ করেছে। তারা বলছেন, সরকারের ভুল নীতি, ভুল পদক্ষেপ এবং সেই সাথে বাজারের উপর কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঠেকানো যায়নি। অগাস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৫৪ শতাংশ হওয়ার মানে হলো ২০২২ সালে দেশে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা ব্যয় করতে হতো এ বছরের আগস্টে সেই একই পণ্য কিনতে ব্যয় করতে হয়েছে ১১২ টাকা ৫৪ পয়সা।
অথচ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা এফএও এর তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসে সারা বিশ্বে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে সর্বনিম্ন হয়েছে। এই সময়ে চাল ও চিনি ছাড়া বিশ্ববাজারে প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দামই কমেছে। এর আগে দেশে পণ্যের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার বিষয়টিকে ব্যবহার করা হলেও এখন সেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গেলেও তার প্রতিফলন কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে এই বিপুল খাদ্য মূল্যস্ফীতির পেছনে নির্দিষ্ট কিছু কারণ আছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। রেকর্ড পরিমাণ টাকা ছাপানো : চলতি অর্থ বছরের শুরুতেই রেকর্ড পরিমাণ টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরের প্রথম আঠারো দিনে সরকারকে সহায়তা করতে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে দশ হাজার আটশ কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সেসময় অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, এভাবে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দেয়ার প্রভাব ঠিক তখনই না হলেও মূল্যস্ফীতি, অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের ওপরই পড়বে । অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এখন যে পণ্যের বাজারে দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা চলছে তার পেছনে এটাও একটা বড় কারণ।
বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয় রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি থাকার কারণে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয় তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন মুদ্রা বা নোট ছাপিয়ে সেই টাকা সরকারকে সরবরাহ করে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, গত অর্থ বছরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়েছে যার জন্য টাকা ছাপাতে হয়েছে এবং এ বছরও সরকার সেই প্রবণতা থেকে সরে আসেনি।
“ফলে মুদ্রানীতিতে যখন দরকার ছিলো মুদ্রা সরবরাহ সংকোচন করা, তখন এই পদক্ষেপটা (কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়াটা), নতুন করে আবার উসকে দিয়েছে মূল্যস্ফীতির সেই প্রবণতাকে,” বলেন তিনি। সুদ হার বাড়েনি : বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে সুদের হার বাড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সুদের হার নির্ধারিত ছিল। যার আওতায় আমানতের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ এবং ঋণের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ সুদের হার ধার্য করা ছিল। যদিও গত মাস দুয়েক সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিষয়ে কিছুটা নমনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা সুদের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্মার্ট সুদহার নামে নতুন নিয়ম চালু করেছে।
স্মার্ট হলো সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল। অর্থাৎ প্রতি মাসে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের ছয় মাসের গড় সুদহার বিবেচনায় নতুন সুদহার ঠিক করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই হারের সাথে সর্বোচ্চ তিন শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারেনি। তাদের মতে, এই ধরণের সুদের হার সুনির্দিষ্ট করে রেখে বা সাম্প্রতিক সময়ে যে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে তা দিয়ে এ ধরণের উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “নীতিগত পর্যায়ে মনিটারি পলিসিতে একটা বড় ধরনের ভুল ছিল।
আর সেই ভুলের যে কারেক্টিং মেজার্স দরকার – তা কিন্তু ঠিকমতো হয়নি।” ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন: ২০২২ সাল থেকে শুরু করে মার্কিন ডলারের বিপরীতে দফায় দফায় টাকার অবমূল্যায়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইনান্সিয়াল স্টেবিলিটি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৩.৩ শতাংশ।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে এক ডলারের বিপরীতে ৮৫.৮০ টাকা পাওয়া যেতো। কিন্তু ওই বছরের ডিসেম্বরে এই বিনিময় হার এসে দাঁড়ায় ১০৫.৪০ টাকায়। আর ২০২৩ সালের ১৪ই অগাস্ট এসে ডলারের দাম ১০৯.৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এতে করে আমদানি কমলেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের অভিঘাত হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিবিসি
সারাবেলার সংবাদ/ এমএএইচ/ ১১ সেপ্টম্বর ২০২৩