ঢাকা ০৯:৩৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo সোনারগাঁয়ে বাস-অ্যাম্বুলেন্সের সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ১০ Logo সোনারগাঁয়ে ২৫কেজি গাঁজা ও পিকআপ ভ্যানসহ আটক-৩ Logo চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারত-পাকিস্তান মহারণের সূচি প্রকাশ Logo শেষ দুই টেস্টও খেলা হচ্ছে না শামির Logo বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদন্তে ৭ সদস্যের কমিশন গঠন Logo বিয়ের পরিকল্পনা নেই! তবে বাবা হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে! সন্তান প্রসঙ্গে কী মত সলমনের? Logo মস্কোয় অতিষ্ঠ! সিরিয়ার পলাতক প্রেসিডেন্টের থেকে ‘মুক্তি’ চাইছেন স্ত্রী, ফিরে যেতে চান ব্রিটেনে Logo ‘বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ২০০ কোটি রুপি পাওনা রয়েছে ত্রিপুরা’ Logo নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন মত Logo শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের তদন্ত নিয়ে যা জানা যাচ্ছে

গ্রিন কোজি কটেজ : রাজধানীতে আরেক মৃত্যুপুরী

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় : ০৮:০০:১৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ মার্চ ২০২৪ ১৩৯ বার পঠিত

ঢাকার বেইলি রোডের সাত তলা ভবনটির নকশা ছিল পাঁচ তলা পর্যন্ত, অনুমোদন ছিল না হোটেল রেস্টুরেন্টের

ভবনটির নাম ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ৷ পুড়ে অনেকটাই কালো হয়ে যাওয়া সেই ভবন এখন যেন মৃত্যুপুরী হয়ে দাঁড়িয়ে!
বৃহস্পতিবার আগুন লাগার পর ‘কাচ্চি ভাই’ নামটাই ছড়িয়েছে মুখে মুখে৷ নানা কাজে সেই ভবনে যাওয়া মানুষদের মধ্যে ৪৬ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আগুন৷ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন অন্তত ১২ জন৷

ঢাকার বেইলি রোডের সাত তলা ওই ভবনটির দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’৷ তয় তলায় একটি পোশাকের দোকান৷ বাকি সব ফ্লোরেই খাবারের দোকান৷ দোকানগুলোর ‘সুনাম’ থাকায় ভিড় লেগেই থাকতো৷ এমন একটি ভবনও যে নানা দিক দিয়ে ‘অবৈধ’ ছিল তা এখন জানা যাচ্ছে৷ কর্তৃপক্ষ এতদিন বিষয়টি জানলেও ব্যবস্থা নেয়নি৷ এতদিন শুধু নোটিশ দিয়েই শেষ হয়েছে তাদের দায়িত্ব৷

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
শুক্রবার সকালে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন,” ভবনটির কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না৷ ভবনটি যে ঝুঁকিপূর্ণ তা জানিয়ে তিনবার চিঠি দেয়া হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে৷” তিনি জানান, বৃহস্পতিবারের অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি গঠন করেছে৷

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, “ওই ভবনের অধিকাংশ রেষ্টুরেন্টে কোনো অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ছিল না৷”

এইভাবে অবৈধ একটি ভবনে কিভাবে এতগুলো প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালিয়েছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ভবনটি অবৈধ কিনা তা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখবে৷ তদন্ত কমিটিও দেখবে৷ ”

র‍্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশিদ হোসেন বলেছেন, “নীচতলার ছোট একটি দোকান থেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়৷ সেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে৷ ভবনটিতে আরো রেষ্টুরেন্ট থাকায় আরো অনেক সিলিন্ডার ছিল৷ ফলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে৷”
জানা গেছে, নীচতলার ওই ছোট দোকানটিও নকশার বাইরে অবৈধভাবে তৈরি করা হয়৷

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান শেলি শুক্রবার ঘটনাস্থন পরিদর্শন করেন৷ পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, “বেইলি রোডের ওই বহুতল ভবনটিতে কোনো ভ্যান্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না৷ এছাড়া ভবনে ফায়ার সরঞ্জাম পাওয়া যায়নি৷” তিনি আরো বলেন,”ভবনের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷ ধোঁয়ার কারণেই বেশিরভাগ মানুষ মারা গেছেন৷”

রাজউক যা বলছে
রাজজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক জানিয়েছেন, তারা কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছেন, ভবনটির নকশা পাঁচ তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক৷ তবে তারা উপরের দুই তলাও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করেছেন৷ রাজউক সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে৷ তারা সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে৷ আর রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, “তাদের অফিস কাম রেসিডেন্সের অনুমোদন থাকলেও হোটেল রেস্টুরেন্টের কোনো অনুমোদন ছিল না৷ মালিক পক্ষ অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ করেছে৷”

রাজউক সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে বেজমেন্টসহ আট তলার বাণিজ্যিক কাম আবাসিক ভবনটির নকশা অনুমোদন দেয় রাজউক৷ ভবনের মালিকের নাম হামিদা খাতুন৷ আর ভবনটির নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন৷ ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো মাইন উদ্দিন বলেন, “ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷ একটিমাত্র সিঁড়ি৷ আর ভবনের একটি ফ্লোর ছাড়া সব ফ্লোরে গ্যাস সিলিন্ডার রাখা ছিল অপরিকল্পিতভাবে৷”

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলি আহমদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমি যা দেখেছি ওই ভবনটির যে কমার্শিয়াল কমপ্লায়েন্স থাকার কথা, তা নাই৷ পুরো ভবনটি কাঁচে ঘেরা৷ ফলে সিঁড়িতে আগুন দ্রুত ট্র্যাভেল করে৷ বিকল্প সিঁড়ি ছিল না৷ ফলে কেউ আর বের হতে পারেনি৷ ”

তার কথা, “এখানে পর্যাপ্ত ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ছিল না৷ হাইড্রেন্ট ছিল না৷ ভবনের ইন্টেরিয়র খুবই দাহ্য৷ পুরো ভবনেই রেষ্টুরেন্ট থাকায় অনেক গ্যাস সিলিন্ডার ছিল৷ এর জন্য যে বাড়তি নিরাপত্তার দরকার ছিল, তা তারা নেয়নি৷” একই ধরনের কথা বলেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক সেলিম নেয়াজ ভুঁইয়া ৷ তার মতে, “ফায়ার আইন ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুয়ায়ী ওই ভবনটি অবৈধ৷ কোনো নিরাপত্তা পরিকল্পনা ছাড়াই ভবনটি তৈরি করা হয়েছে৷ ”

আর নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, “আমি যা দেখেছি তাতে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি৷ আবাসিক ভবনের চেয়ে বাণিজ্যিক ভবনের নিরাপত্তা আরো বেশি থাকা প্রয়োজন৷ কিন্তু তারা সেটা করেনি৷ এখানে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন সবার দায় আছে৷ কিন্তু কেউ ব্যবস্থা নেয়নি৷”

কয় তলা হলে বহুতল?

রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, “ফায়ার আইনে ছয় তলার বেশি হলেই সেটা বহুতল ভবন৷ তবে রাজউক আইনে ১০ তলার বেশি হলে বহুতল৷ এখানে আইনটি সাংঘর্ষিক৷ ফায়ার আইনে থাকলেও আমাদের আইনে ওই ভবনের আলাদা ফায়ার সিঁড়ি দরকার নেই৷ তারপরও আমার মনে হয় আবাসিক ভবনের জন্য ১০ তলার বেশি ঠিক আছে৷ কিন্তু বাণিজ্যিক ভবনের জন্য ছয় তলার বেশি হলে ডাবল সিঁড়ি থাকা উচিত৷ আর ওই ভবনটিতে অনুমোদন না নিয়ে রেষ্টুরেন্ট করা হয়েছে৷ অনেক গ্যাস সিলিন্ডার বসানো হয়েছে৷ তাই সব ধরনের অগ্নিনরাপত্তা থাকা উচিত ছিল৷”

আগুন প্রাণ যায়, বিচার হয় না

গত ১৪ বছরে ঢাকায় কমপক্ষে ১০টি বড় ধরনের আগুনের ঘটনা ঘটেছে৷ নীমতলী, চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ারের পর বেইলি রোড আরো একটি ট্র্যাজেডি যোগ করলো৷ এই চারটি ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৬৭ জনের৷ এছাড়া, গত কয়েক বছরে বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় আগুনের ঘটনা ঘটেছে৷ প্রতিটি ঘটনার পরই অনেক কথা হয়, কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয় না৷ দায়ীরা আসেনা বিচারের আওতায়৷

২০১০ সালের ৩ জুন রাতে ঢাকার নিমতলীতে আগুনে মারা যান ১২৪ জন, আহত হন প্রায় অর্ধশতাধিক, পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা৷ নিমতলীতে কেমিকেল গোডাউন থাকায় ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে৷ নিমতলীর ওই গোডাউনগুলো ১৩ বছরেও সরানো যায়নি৷

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় আগুনে ৭১ জন মারা যান, আহত হন কয়েকশ মানুষ৷ ওই আগুন নেভাতে ১৪ ঘন্টা সময় লেগেছিল৷ কারণ ওই এলাকা এতই ঘিঞ্জি ছিল যে, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িই সেখানে যেতে পারেনি৷
বনানীর বহুতল বাণ্যিজিক ভবন এফআর টাওয়ারে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুরে আগুন লেগে ২৭ জনের মৃত্যু হয় এবং শতাধিক আহত হন৷ ২২তলা ওই ভবনটিতে ছিল না অগ্নি নিরাপত্তা৷ মামলা হলেও মালিকপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় তারা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে৷

২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যায় মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকার ‘রাখি নীড়’ নামে একটি ভবনের নীচতলায় বিস্ফোরণ হয়৷ ওই ঘটনায় ১২ জন মারা যান৷ একটি ফুডশপে গ্যাসের বিস্ফোরণ থেকে পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়েছিল৷

২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজারে আগুন লাগে৷ সেদিন বঙ্গবাজারের পাশাপাশি আরও চারটি মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
ওই বছরের ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আগুনে ২২৬টি দোকান পুড়ে যায় ৷

কিন্তু কোনো ঘটনার জন্যই কারো শাস্তি হওয়ার নজির নেই৷ প্রতিটি ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কোনো তদন্তই আলোর মুখ দেখেনি৷ বরং যাদের এগুলো দেখার দায়িত্ব, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, “এখানে রাজউক, ফায়াার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন সবার দায় আছে৷ দায় আছে ভবন মালিকদের৷ তাদের আইনের আওতায় আনা দরকার৷ সেটা হয় না বলেই বার বার আমরা মৃত্যু দেখি৷”

তার কথা, “আইন আছে, কিন্তু অর্থের বিনিময়ে ভবন মালিকরা ত্রুটিপূর্ণ ভবনের অনুমোদন নেন৷ আবার ভবন নির্মাণের পর অর্থের বিনিময়ে আইন লঙ্ঘন করে পার পেয়ে যান৷ কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই এই অবৈধ কাজ চলে৷”

রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, “আমরা নকশায় ব্যত্যয় হলে ব্যবস্থা নিতে পারি৷ আমরা ছাড়া ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশনেরও দায় আছে৷ তবে প্রাণহানির ব্যাপারে ফৌজদাারি মামলা তো পুলিশ বা ক্ষতিগ্রস্তরা করবে৷”

একই ধরনের কথা বলেন ফায়ার সার্ভিসের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার৷ তিনি বলেন, “আমরা নোটিশ দিতে পারি, মামলা করতে পারি না৷” বেইলি রোডের ঘটনায় তারা কোনো মামলা করেননি জানিয়ে তিনি বলেন,” তদন্ত কমিটি তদন্ত করছে৷ তদন্ত শেষ হলে বলা যাবে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷” ডয়চে ভেলে
Facebook Comments Box
ট্যাগস :

গ্রিন কোজি কটেজ : রাজধানীতে আরেক মৃত্যুপুরী

আপডেট সময় : ০৮:০০:১৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ মার্চ ২০২৪
ভবনটির নাম ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ৷ পুড়ে অনেকটাই কালো হয়ে যাওয়া সেই ভবন এখন যেন মৃত্যুপুরী হয়ে দাঁড়িয়ে!
বৃহস্পতিবার আগুন লাগার পর ‘কাচ্চি ভাই’ নামটাই ছড়িয়েছে মুখে মুখে৷ নানা কাজে সেই ভবনে যাওয়া মানুষদের মধ্যে ৪৬ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আগুন৷ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন অন্তত ১২ জন৷

ঢাকার বেইলি রোডের সাত তলা ওই ভবনটির দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’৷ তয় তলায় একটি পোশাকের দোকান৷ বাকি সব ফ্লোরেই খাবারের দোকান৷ দোকানগুলোর ‘সুনাম’ থাকায় ভিড় লেগেই থাকতো৷ এমন একটি ভবনও যে নানা দিক দিয়ে ‘অবৈধ’ ছিল তা এখন জানা যাচ্ছে৷ কর্তৃপক্ষ এতদিন বিষয়টি জানলেও ব্যবস্থা নেয়নি৷ এতদিন শুধু নোটিশ দিয়েই শেষ হয়েছে তাদের দায়িত্ব৷

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
শুক্রবার সকালে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন,” ভবনটির কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না৷ ভবনটি যে ঝুঁকিপূর্ণ তা জানিয়ে তিনবার চিঠি দেয়া হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে৷” তিনি জানান, বৃহস্পতিবারের অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি গঠন করেছে৷

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, “ওই ভবনের অধিকাংশ রেষ্টুরেন্টে কোনো অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ছিল না৷”

এইভাবে অবৈধ একটি ভবনে কিভাবে এতগুলো প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালিয়েছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ভবনটি অবৈধ কিনা তা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখবে৷ তদন্ত কমিটিও দেখবে৷ ”

র‍্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশিদ হোসেন বলেছেন, “নীচতলার ছোট একটি দোকান থেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়৷ সেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে৷ ভবনটিতে আরো রেষ্টুরেন্ট থাকায় আরো অনেক সিলিন্ডার ছিল৷ ফলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে৷”
জানা গেছে, নীচতলার ওই ছোট দোকানটিও নকশার বাইরে অবৈধভাবে তৈরি করা হয়৷

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান শেলি শুক্রবার ঘটনাস্থন পরিদর্শন করেন৷ পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, “বেইলি রোডের ওই বহুতল ভবনটিতে কোনো ভ্যান্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না৷ এছাড়া ভবনে ফায়ার সরঞ্জাম পাওয়া যায়নি৷” তিনি আরো বলেন,”ভবনের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷ ধোঁয়ার কারণেই বেশিরভাগ মানুষ মারা গেছেন৷”

রাজউক যা বলছে
রাজজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক জানিয়েছেন, তারা কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছেন, ভবনটির নকশা পাঁচ তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক৷ তবে তারা উপরের দুই তলাও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করেছেন৷ রাজউক সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে৷ তারা সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে৷ আর রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, “তাদের অফিস কাম রেসিডেন্সের অনুমোদন থাকলেও হোটেল রেস্টুরেন্টের কোনো অনুমোদন ছিল না৷ মালিক পক্ষ অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ করেছে৷”

রাজউক সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে বেজমেন্টসহ আট তলার বাণিজ্যিক কাম আবাসিক ভবনটির নকশা অনুমোদন দেয় রাজউক৷ ভবনের মালিকের নাম হামিদা খাতুন৷ আর ভবনটির নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন৷ ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো মাইন উদ্দিন বলেন, “ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷ একটিমাত্র সিঁড়ি৷ আর ভবনের একটি ফ্লোর ছাড়া সব ফ্লোরে গ্যাস সিলিন্ডার রাখা ছিল অপরিকল্পিতভাবে৷”

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলি আহমদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমি যা দেখেছি ওই ভবনটির যে কমার্শিয়াল কমপ্লায়েন্স থাকার কথা, তা নাই৷ পুরো ভবনটি কাঁচে ঘেরা৷ ফলে সিঁড়িতে আগুন দ্রুত ট্র্যাভেল করে৷ বিকল্প সিঁড়ি ছিল না৷ ফলে কেউ আর বের হতে পারেনি৷ ”

তার কথা, “এখানে পর্যাপ্ত ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ছিল না৷ হাইড্রেন্ট ছিল না৷ ভবনের ইন্টেরিয়র খুবই দাহ্য৷ পুরো ভবনেই রেষ্টুরেন্ট থাকায় অনেক গ্যাস সিলিন্ডার ছিল৷ এর জন্য যে বাড়তি নিরাপত্তার দরকার ছিল, তা তারা নেয়নি৷” একই ধরনের কথা বলেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক সেলিম নেয়াজ ভুঁইয়া ৷ তার মতে, “ফায়ার আইন ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুয়ায়ী ওই ভবনটি অবৈধ৷ কোনো নিরাপত্তা পরিকল্পনা ছাড়াই ভবনটি তৈরি করা হয়েছে৷ ”

আর নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, “আমি যা দেখেছি তাতে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি৷ আবাসিক ভবনের চেয়ে বাণিজ্যিক ভবনের নিরাপত্তা আরো বেশি থাকা প্রয়োজন৷ কিন্তু তারা সেটা করেনি৷ এখানে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন সবার দায় আছে৷ কিন্তু কেউ ব্যবস্থা নেয়নি৷”

কয় তলা হলে বহুতল?

রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, “ফায়ার আইনে ছয় তলার বেশি হলেই সেটা বহুতল ভবন৷ তবে রাজউক আইনে ১০ তলার বেশি হলে বহুতল৷ এখানে আইনটি সাংঘর্ষিক৷ ফায়ার আইনে থাকলেও আমাদের আইনে ওই ভবনের আলাদা ফায়ার সিঁড়ি দরকার নেই৷ তারপরও আমার মনে হয় আবাসিক ভবনের জন্য ১০ তলার বেশি ঠিক আছে৷ কিন্তু বাণিজ্যিক ভবনের জন্য ছয় তলার বেশি হলে ডাবল সিঁড়ি থাকা উচিত৷ আর ওই ভবনটিতে অনুমোদন না নিয়ে রেষ্টুরেন্ট করা হয়েছে৷ অনেক গ্যাস সিলিন্ডার বসানো হয়েছে৷ তাই সব ধরনের অগ্নিনরাপত্তা থাকা উচিত ছিল৷”

আগুন প্রাণ যায়, বিচার হয় না

গত ১৪ বছরে ঢাকায় কমপক্ষে ১০টি বড় ধরনের আগুনের ঘটনা ঘটেছে৷ নীমতলী, চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ারের পর বেইলি রোড আরো একটি ট্র্যাজেডি যোগ করলো৷ এই চারটি ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৬৭ জনের৷ এছাড়া, গত কয়েক বছরে বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় আগুনের ঘটনা ঘটেছে৷ প্রতিটি ঘটনার পরই অনেক কথা হয়, কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয় না৷ দায়ীরা আসেনা বিচারের আওতায়৷

২০১০ সালের ৩ জুন রাতে ঢাকার নিমতলীতে আগুনে মারা যান ১২৪ জন, আহত হন প্রায় অর্ধশতাধিক, পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা৷ নিমতলীতে কেমিকেল গোডাউন থাকায় ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে৷ নিমতলীর ওই গোডাউনগুলো ১৩ বছরেও সরানো যায়নি৷

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় আগুনে ৭১ জন মারা যান, আহত হন কয়েকশ মানুষ৷ ওই আগুন নেভাতে ১৪ ঘন্টা সময় লেগেছিল৷ কারণ ওই এলাকা এতই ঘিঞ্জি ছিল যে, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িই সেখানে যেতে পারেনি৷
বনানীর বহুতল বাণ্যিজিক ভবন এফআর টাওয়ারে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুরে আগুন লেগে ২৭ জনের মৃত্যু হয় এবং শতাধিক আহত হন৷ ২২তলা ওই ভবনটিতে ছিল না অগ্নি নিরাপত্তা৷ মামলা হলেও মালিকপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় তারা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে৷

২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যায় মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকার ‘রাখি নীড়’ নামে একটি ভবনের নীচতলায় বিস্ফোরণ হয়৷ ওই ঘটনায় ১২ জন মারা যান৷ একটি ফুডশপে গ্যাসের বিস্ফোরণ থেকে পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়েছিল৷

২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজারে আগুন লাগে৷ সেদিন বঙ্গবাজারের পাশাপাশি আরও চারটি মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
ওই বছরের ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আগুনে ২২৬টি দোকান পুড়ে যায় ৷

কিন্তু কোনো ঘটনার জন্যই কারো শাস্তি হওয়ার নজির নেই৷ প্রতিটি ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কোনো তদন্তই আলোর মুখ দেখেনি৷ বরং যাদের এগুলো দেখার দায়িত্ব, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, “এখানে রাজউক, ফায়াার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন সবার দায় আছে৷ দায় আছে ভবন মালিকদের৷ তাদের আইনের আওতায় আনা দরকার৷ সেটা হয় না বলেই বার বার আমরা মৃত্যু দেখি৷”

তার কথা, “আইন আছে, কিন্তু অর্থের বিনিময়ে ভবন মালিকরা ত্রুটিপূর্ণ ভবনের অনুমোদন নেন৷ আবার ভবন নির্মাণের পর অর্থের বিনিময়ে আইন লঙ্ঘন করে পার পেয়ে যান৷ কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই এই অবৈধ কাজ চলে৷”

রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, “আমরা নকশায় ব্যত্যয় হলে ব্যবস্থা নিতে পারি৷ আমরা ছাড়া ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশনেরও দায় আছে৷ তবে প্রাণহানির ব্যাপারে ফৌজদাারি মামলা তো পুলিশ বা ক্ষতিগ্রস্তরা করবে৷”

একই ধরনের কথা বলেন ফায়ার সার্ভিসের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার৷ তিনি বলেন, “আমরা নোটিশ দিতে পারি, মামলা করতে পারি না৷” বেইলি রোডের ঘটনায় তারা কোনো মামলা করেননি জানিয়ে তিনি বলেন,” তদন্ত কমিটি তদন্ত করছে৷ তদন্ত শেষ হলে বলা যাবে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷” ডয়চে ভেলে
Facebook Comments Box