গ্রিন কোজি কটেজ : রাজধানীতে আরেক মৃত্যুপুরী
- আপডেট সময় : ০৮:০০:১৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ মার্চ ২০২৪ ১৩৯ বার পঠিত
ঢাকার বেইলি রোডের সাত তলা ওই ভবনটির দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’৷ তয় তলায় একটি পোশাকের দোকান৷ বাকি সব ফ্লোরেই খাবারের দোকান৷ দোকানগুলোর ‘সুনাম’ থাকায় ভিড় লেগেই থাকতো৷ এমন একটি ভবনও যে নানা দিক দিয়ে ‘অবৈধ’ ছিল তা এখন জানা যাচ্ছে৷ কর্তৃপক্ষ এতদিন বিষয়টি জানলেও ব্যবস্থা নেয়নি৷ এতদিন শুধু নোটিশ দিয়েই শেষ হয়েছে তাদের দায়িত্ব৷
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
শুক্রবার সকালে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন,” ভবনটির কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না৷ ভবনটি যে ঝুঁকিপূর্ণ তা জানিয়ে তিনবার চিঠি দেয়া হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে৷” তিনি জানান, বৃহস্পতিবারের অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি গঠন করেছে৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, “ওই ভবনের অধিকাংশ রেষ্টুরেন্টে কোনো অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ছিল না৷”
র্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশিদ হোসেন বলেছেন, “নীচতলার ছোট একটি দোকান থেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়৷ সেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে৷ ভবনটিতে আরো রেষ্টুরেন্ট থাকায় আরো অনেক সিলিন্ডার ছিল৷ ফলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে৷”
জানা গেছে, নীচতলার ওই ছোট দোকানটিও নকশার বাইরে অবৈধভাবে তৈরি করা হয়৷
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান শেলি শুক্রবার ঘটনাস্থন পরিদর্শন করেন৷ পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, “বেইলি রোডের ওই বহুতল ভবনটিতে কোনো ভ্যান্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না৷ এছাড়া ভবনে ফায়ার সরঞ্জাম পাওয়া যায়নি৷” তিনি আরো বলেন,”ভবনের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷ ধোঁয়ার কারণেই বেশিরভাগ মানুষ মারা গেছেন৷”
রাজউক যা বলছে
রাজজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক জানিয়েছেন, তারা কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছেন, ভবনটির নকশা পাঁচ তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক৷ তবে তারা উপরের দুই তলাও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করেছেন৷ রাজউক সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে৷ তারা সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে৷ আর রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, “তাদের অফিস কাম রেসিডেন্সের অনুমোদন থাকলেও হোটেল রেস্টুরেন্টের কোনো অনুমোদন ছিল না৷ মালিক পক্ষ অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ করেছে৷”
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলি আহমদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমি যা দেখেছি ওই ভবনটির যে কমার্শিয়াল কমপ্লায়েন্স থাকার কথা, তা নাই৷ পুরো ভবনটি কাঁচে ঘেরা৷ ফলে সিঁড়িতে আগুন দ্রুত ট্র্যাভেল করে৷ বিকল্প সিঁড়ি ছিল না৷ ফলে কেউ আর বের হতে পারেনি৷ ”
তার কথা, “এখানে পর্যাপ্ত ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ছিল না৷ হাইড্রেন্ট ছিল না৷ ভবনের ইন্টেরিয়র খুবই দাহ্য৷ পুরো ভবনেই রেষ্টুরেন্ট থাকায় অনেক গ্যাস সিলিন্ডার ছিল৷ এর জন্য যে বাড়তি নিরাপত্তার দরকার ছিল, তা তারা নেয়নি৷” একই ধরনের কথা বলেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক সেলিম নেয়াজ ভুঁইয়া ৷ তার মতে, “ফায়ার আইন ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুয়ায়ী ওই ভবনটি অবৈধ৷ কোনো নিরাপত্তা পরিকল্পনা ছাড়াই ভবনটি তৈরি করা হয়েছে৷ ”
আর নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, “আমি যা দেখেছি তাতে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি৷ আবাসিক ভবনের চেয়ে বাণিজ্যিক ভবনের নিরাপত্তা আরো বেশি থাকা প্রয়োজন৷ কিন্তু তারা সেটা করেনি৷ এখানে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন সবার দায় আছে৷ কিন্তু কেউ ব্যবস্থা নেয়নি৷”
কয় তলা হলে বহুতল?
রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, “ফায়ার আইনে ছয় তলার বেশি হলেই সেটা বহুতল ভবন৷ তবে রাজউক আইনে ১০ তলার বেশি হলে বহুতল৷ এখানে আইনটি সাংঘর্ষিক৷ ফায়ার আইনে থাকলেও আমাদের আইনে ওই ভবনের আলাদা ফায়ার সিঁড়ি দরকার নেই৷ তারপরও আমার মনে হয় আবাসিক ভবনের জন্য ১০ তলার বেশি ঠিক আছে৷ কিন্তু বাণিজ্যিক ভবনের জন্য ছয় তলার বেশি হলে ডাবল সিঁড়ি থাকা উচিত৷ আর ওই ভবনটিতে অনুমোদন না নিয়ে রেষ্টুরেন্ট করা হয়েছে৷ অনেক গ্যাস সিলিন্ডার বসানো হয়েছে৷ তাই সব ধরনের অগ্নিনরাপত্তা থাকা উচিত ছিল৷”
আগুন প্রাণ যায়, বিচার হয় না
গত ১৪ বছরে ঢাকায় কমপক্ষে ১০টি বড় ধরনের আগুনের ঘটনা ঘটেছে৷ নীমতলী, চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ারের পর বেইলি রোড আরো একটি ট্র্যাজেডি যোগ করলো৷ এই চারটি ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৬৭ জনের৷ এছাড়া, গত কয়েক বছরে বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় আগুনের ঘটনা ঘটেছে৷ প্রতিটি ঘটনার পরই অনেক কথা হয়, কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয় না৷ দায়ীরা আসেনা বিচারের আওতায়৷
২০১০ সালের ৩ জুন রাতে ঢাকার নিমতলীতে আগুনে মারা যান ১২৪ জন, আহত হন প্রায় অর্ধশতাধিক, পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা৷ নিমতলীতে কেমিকেল গোডাউন থাকায় ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে৷ নিমতলীর ওই গোডাউনগুলো ১৩ বছরেও সরানো যায়নি৷
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় আগুনে ৭১ জন মারা যান, আহত হন কয়েকশ মানুষ৷ ওই আগুন নেভাতে ১৪ ঘন্টা সময় লেগেছিল৷ কারণ ওই এলাকা এতই ঘিঞ্জি ছিল যে, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িই সেখানে যেতে পারেনি৷
বনানীর বহুতল বাণ্যিজিক ভবন এফআর টাওয়ারে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুরে আগুন লেগে ২৭ জনের মৃত্যু হয় এবং শতাধিক আহত হন৷ ২২তলা ওই ভবনটিতে ছিল না অগ্নি নিরাপত্তা৷ মামলা হলেও মালিকপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় তারা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে৷
২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যায় মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকার ‘রাখি নীড়’ নামে একটি ভবনের নীচতলায় বিস্ফোরণ হয়৷ ওই ঘটনায় ১২ জন মারা যান৷ একটি ফুডশপে গ্যাসের বিস্ফোরণ থেকে পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়েছিল৷
২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজারে আগুন লাগে৷ সেদিন বঙ্গবাজারের পাশাপাশি আরও চারটি মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
ওই বছরের ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আগুনে ২২৬টি দোকান পুড়ে যায় ৷
কিন্তু কোনো ঘটনার জন্যই কারো শাস্তি হওয়ার নজির নেই৷ প্রতিটি ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কোনো তদন্তই আলোর মুখ দেখেনি৷ বরং যাদের এগুলো দেখার দায়িত্ব, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, “এখানে রাজউক, ফায়াার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন সবার দায় আছে৷ দায় আছে ভবন মালিকদের৷ তাদের আইনের আওতায় আনা দরকার৷ সেটা হয় না বলেই বার বার আমরা মৃত্যু দেখি৷”
তার কথা, “আইন আছে, কিন্তু অর্থের বিনিময়ে ভবন মালিকরা ত্রুটিপূর্ণ ভবনের অনুমোদন নেন৷ আবার ভবন নির্মাণের পর অর্থের বিনিময়ে আইন লঙ্ঘন করে পার পেয়ে যান৷ কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই এই অবৈধ কাজ চলে৷”
রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, “আমরা নকশায় ব্যত্যয় হলে ব্যবস্থা নিতে পারি৷ আমরা ছাড়া ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশনেরও দায় আছে৷ তবে প্রাণহানির ব্যাপারে ফৌজদাারি মামলা তো পুলিশ বা ক্ষতিগ্রস্তরা করবে৷”