মামলার তদন্ত ও বিচারে সময় পার করার নেপথ্যে কী ?
- আপডেট সময় : ১০:৪৮:৫১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ১২৯ বার পঠিত
বাদীর আইনজীবী ফারুক আহমেদ জানান, ‘‘রায় প্রস্তুত না হওয়ায় বিচারক সময় নিয়েছেন৷ আমরা ৩৫ বছর অপেক্ষা করেছি৷ আরো কয়েকটা দিন না হয় অপেক্ষা করব৷”
এমন আরো অনেক মামলার বিচার পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়৷ এর কারণ কী?
সগিরা মোর্শেদ হত্যার তদন্তে ৩১ বছর
সগিরা মোর্শেদ হত্যার বিচার পেতে ৩৫ বছরে অপেক্ষা ৷ এরমধ্যে তদন্তেই কেটেছে ৩১ বছর৷ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি৷ তিনবার তদন্ত সংস্থা বদলের পর একযুগ ধরে মামলাটির তদন্ত করছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন( র্যাব) আদালতের নির্দেশে৷ এপর্যন্ত ১০৭ বার সময় নিয়েও তারা কোনো তদন্ত অগ্রগতি রিপোর্ট দিতে পারেনি৷ চিহ্নিত করতে পারেনি হত্যাকারীদের৷ বিচার তো অনেক দূরে একযুগে তদন্তই শেষ হয়নি৷
২০০০ সালের ১ জুলাই ঢাকার পশ্চিম হাজীপাড়ার বাসায় খুন হয়েছিলেন সিটি কলেজের অনার্সের ছাত্রী রুশদানিয়া ইসলাম বুশরা৷ ওই মামলায় ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর পুলিশ চার্জশিট দেয়৷ ২০০৩ সালের ৩০ জুন মামলার রায়ে বুশরার সৎ ভাই কাদের, শ্যালক শওকত ও কবিরকে মৃত্যুদণ্ড এবং কাদেরের স্ত্রী রুনুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ কিন্তু আপীলে ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে আসামীরা সবাই খালাস পান৷ এর প্রতিক্রিয়ায় বুশরার মা লায়লা ইসলাম তখন বলেছিলেন,”এখন মনে হয়, বুশরা বলতে কেউ জন্মগ্রহণই করেনি৷ বুশরা নামে কেউ ছিল না, কেউ খুনও হয়নি৷”
শুধু এই তিনটি ঘটনা নয় হত্যাকাণ্ডের মত ফৌজদারি অনেক মামলাই তদন্তের নামে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে৷ আর তদন্ত শেষে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পর দেখা যায় অধিকাংশ মামলায়ই আসামিরা খালাস পেয়ে যান৷
মামলার তদন্ত, বিচার, সময়ক্ষেপণ এবং দুর্বল তদন্ত নিয়ে তদন্তকারী, সাবেক বিচারক, আইনজীবী ও অপরাধ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে এখানে সাধারণ কিছু কারণ আছে৷ আর তা হলো তদন্তকারীদের অদক্ষতা, তদন্তে মনোযোগ দিতে না পারা এবং বিচারকের সংকট৷ তবে এর বাইরে সরকারের প্রভাব, অর্থের প্রভাব , দুর্নীতি এবং আইনের নানা প্যাঁচ৷ শেষের সব কারণগুলোই ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীরা ব্যবহার করতে পারে৷ তাদের লক্ষ্য থাকে মামলা তদন্ত পর্যায়েই শেষ করে দেয়ার৷ সেটা না পারলে তদন্ত দীর্ঘায়িত করা৷ তদন্ত দীর্ঘায়িত হলে মামলা দুর্বল হয়ে যায়৷ আলমত নষ্ট হয়ে যায়, সাক্ষী পাওয়া যায়না৷ ফলে বাদী বিচারে তার পক্ষে রায় পাননা৷ আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায়৷ আবার সেটা না পারলে দুর্বল চর্জশিট দাখিল করানো হয়৷ তাতেও আসামি সুবিধা পায়৷
প্রতিবেদনে যে চারটি মামলার কথা বলা হয়েছে তাতে ওই কারণগুলোর প্রভাব স্পষ্ট৷ সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মুনির মনে করেন, ‘‘এই সরকার সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত চায় না বলেই হত্যাকারীরা চিহ্নিত হচ্ছে না৷ মামলা তদন্তও শেষ হচেছ না৷” তাই তিনি মনে করেন তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন করেও কোনো লাভ হবে না৷
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাসহ অনেক জটিল মামলার তদন্তকারী সিআইডির সাবেক ডিআইজি আব্দুল কাহার আকন্দ বলেন, ‘‘তদন্ত যত দেরি হবে বিচার পাওয়াও তত কঠিন হবে৷ কারণ তদন্তে দেরি হলে আলামত, সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়৷ সাক্ষীরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে৷”
তার কথা, ‘‘সিআইডি এবং যারা বিশেষভাবে তদন্তে নিয়োজিত তারা যত গভীরভাবে কাজ করেন থানা পুলিশ সেভাবে করেনা৷ একজন সাব ইন্সপেক্টর তদন্ত করেন ওসি সাহেক দেখে দেন৷ কিন্তু তদন্ত করে যদি সঠিকভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ না করা হয়৷ তারপর সেটা ঠিকভাবে আদালতে উপস্থাপন না করা হয় তাহলে বিচারে গিয়ে ফল পাওয়া যায় না৷ ফলে অনেক মামলায় শেষ পর্যন্ত শাস্তি হয়না৷ রুশদানিয়া ইসলাম বুশরা হত্যায় সব আসামির খালাস পাওয়ার কারণ দুর্বল তদন্ত হতে পারে৷”
তার কথা, ‘‘অদক্ষতা তো আছেই তার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত না করার বিষয়ও থাকে৷ আধুনিক তদন্তের সব সুবিধা সিআইডিতে আছে৷ থানা পুলিশ চাইলে তার সহায়তা নিতে পারে ৷ তবে খুব একটা নিতে দেখিনি৷”
সংকট কোথায়
বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলায় সর্বোচ্চ ১৫ ভাগে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা যায় এবং শাস্তি হয়৷ আর সর্বোচ্চ আদালতসহ সব আদালত মিলে ৪০ লাখ মামলা বিচারের অপেক্ষায় আছে৷ নতুন কোনো মামলা বিচারের জন্য না গেলেও যে বিচারক আছেন তাদের এই মামলা নিস্পত্তি করতে ১৬ বছর লাগবে৷ দেশের নিম্ন আদালতে ২০ বছর ধরে ঝুলে আছে এমন মামলার সংখ্যা ২০২২ সালে ছিলো ছয় হাজার ৬৮১টি৷
তার কথা,”পুলিশে যারা তদন্ত করেন তাদের এর বাইরেও অনেক কাজ করতে হয়৷ সে কারণেও তদন্ত দীর্ঘদিন ধরে চলে৷ আইনে মামলার তদন্ত শেষ করার জন্য সময় নির্ধারিত থাকলেও তা মানা হয়না৷ আর বিচারকের সংখ্যা কম বলে মামলা জটলেগে যায়৷”
সরকারের দানবীয় ক্ষমতা
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না কয়েকটি মামলার উদাহরণ দিয়ে বলেন,”অদক্ষতা, তদন্তে ত্রুটি তো আছে৷ কিন্তু সাগর-রুনি, কল্পনা চাকমা, রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ, যশোরের শামসুর রহমান, উদীচীর মামলার ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? সেগুলোর কী অবস্থা হয়েছে৷ এখানে সরকারের কোনো ভূমিকা নাই৷ ওগুলোর বিচার হবে কবে?”
আর সাবেক জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘‘সরকার হচ্ছে এমন এতটা শক্তি, এটা হলো দৈত্য দানবের মতো৷ তারা যা চায় তাই করিয়ে নিতে পারে৷ ফলে কোনো মামলা সরকার যদি মনে করে প্রভাবিত করতে পারে৷ আর বিচারক, তদন্তকারী এদের সংকট তো আছেই৷ দেশে এখন ১০ হাজার বিচারক প্রয়োজন৷”
তিনি বলেন, ‘‘ক্ষমতা অর্থ সব কিছু দিয়ে তদন্ত প্রভাবিত করা যায়৷ দেশে তো কোনো ক্ষমতাশালীর বিচার হতে দেখিনি৷ আর গরিবে গরিবে মামলা হলে পুলিশের মেজাজ মর্জির ওপর তদন্ত নির্ভর করে৷”