ঢাকা ০৮:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo আওয়ামী দোসরদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে সরকার সফল হবে না: তারেক Logo স্বৈরাচারের হিংস্র থাবা থেকে দেশ এখনও মুক্ত নয়: রিজভী Logo হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে যেভাবে ইসরায়েল খুঁজে বের করে হত্যা করেছে Logo সোনারগাঁওয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে যুবকের মৃত্যু Logo সংবাদ প্রকাশের পর বৃদ্ধা মহিলার ঠাই হলো স্বামীর বসত ভিটায় Logo সোনারগাঁয়ে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারি হালট দখল করে বালু ভরাট Logo ‘সংস্কারের ধীর গতি’ ও কাজের গুরুত্ব নির্ধারণ নিয়ে সমালোচনা, কী বলছেন উপদেষ্টারা? Logo আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু আজ Logo বাড়তে পারে ঈদ ও পূজার সরকারি ছুটি Logo আগামী বছর থেকে আবারও মাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজন শুরু

এমসি কলেজ থেকে জাহাঙ্গীরনগর

সারাবেলা প্রতিবেদন
  • আপডেট সময় : ০৮:৩৬:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ১১০ বার পঠিত

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের আগের ঘটনাগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় তারা বেপরোয়া বলে মনে করেন কেউ কেউ

জাহাঙ্গীরনগরের ঘটনা শনিবার রাতের৷ যে ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে তাদের মধ্যে দুইজন এখনো পলাতক৷ অভিযুক্তরা মীর মোশররফ হোসেন হলের ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নাম্বার কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে বেটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে ধর্ষণ করে৷ ধর্ষকদের একজন ওই দম্পতির পরিচিত হওয়ায় তারা কৌশলে তাদের বাইরে থেকে ডেকে আনে৷

এই ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের কেন্দ্রে রয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান৷ তার সঙ্গে ছিলেন একই বিভাগের সাগর সিদ্দিকী ও হাসানুজ্জামান এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান৷ পলাতক আছেন ভুক্তভোগীর পূর্বপরিচিত মো. মামুনুর রশিদ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক মুরাদ হোসেন৷

ছাত্র না হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থান এবং ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়া অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে৷ আর মূল হোতা ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানের কয়েকদিন আগের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়েছে৷ সেখানে তিনি দাবি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে তার হাত ছিলো৷

ছাত্রলীগের আরো দায়

সিলেট এমসি কলেজের শ্রীকান্ত ছাত্রাবাসে ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ধর্ষণ করে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী৷ ওই সময় কলেজ বন্ধ থাকলেও হলে থাকতেন জেলা আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরা৷ ঘটনার দিন আক্রান্ত নারী স্বামীকে নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে গিয়েছিলেন৷ রাত ৮টার দিতে তার স্বামী হোস্টেলের গেটে সিগারেট কিনতে  নামলে ধর্ষকেরা ওই নারীকে ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে৷ তার স্বামীকেও তারা আটকে রেখে মারধর করে৷

ওই ঘটনায় আট ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে তিন বছর আগে আদালতে চার্জশিট দেয়া হলেও এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি৷

এরকম আরও অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ ২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি গোপালগঞ্জের মকসুদপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নঈম কাজীর নেতৃত্বে চারজন এক তরুণীতে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে৷ মামলার দেড় মাস পর পুলিশ ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করে৷ ওই মামলায় এখনো চার্জশিট হয়নি বলে জানা গেছে৷

একই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি সাভার সদর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানা এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে৷ তার বিরুদ্ধে মামলা হলে চারদিন পর র‌্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে৷

গত ১৪ জানুয়ারি বাগেরহাটের ফফিরহাটে উপজেলা সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি শাকিল আহমেদ ও তার সহযোগীরা দুই তরুণীকে রাস্তা থেকে অপহরণ করে নিয়ে ধর্ষণ করে৷ পরে শাকিলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও তার সহযোগীরা পলাতক আছে৷

২০২৩ সালের ২৫ জুন রাতে রংপুরের পীরগঞ্জে এক গৃহবধুকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয় জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ইয়াসিন  আরাফাতের বিরুদ্ধে৷ ওই গৃহবধুকে জিম্মি করে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ৷ খোঁজ নিয়ে জানাগেছে ওই ছাত্রলীগ নেতা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি৷

২০১৯ সালে রংপুরের হারগাছা এলাকায় এক স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের পর তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় হারগাছার সারাই ইউনিয়নের ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ  সম্পাদক রাসেল মিয়া৷ পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷

এমসি কলেজ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সিলেট এমসি কলেজে নববধুকে ধর্ষণের ঘটনার পর ধর্ষকদের প্রশ্রয়দাতারা  ওই নারীর চরিত্রহননে নেমেছিল৷ কারণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা কলেজে কমিটি না থাকলেও তাদের দিয়ে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বাজয় রাখতেন৷ তিনি চেষ্টা করেছিলেন রাতেই ঘটনাটি মিটমাট করে ফেলতে৷ না পেরে ওই নেতা তাদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন৷ পরে অবশ্য পুলিশ তাদের আটক করে৷ কিন্তু তাদের বিচার এখানো হয়নি৷

ছাত্রলীগের আট নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে চার্জশিট ও অভিযোগ গঠন হলেও সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে না৷ গত তিন বছর ধরে সাক্ষীর জন্য ঝুলে আছে৷ আদৌ প্রভাবশালীদের চাপের মুখে সাক্ষী পাওয়া যাবে কী না সন্দেহ৷ এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার ও নারীর স্বামীকে হত্যারও হুমকি দেয়া হয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত বিচার কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারছেন না৷ সিলেটের নারী নেত্রী তামান্না আহমেদ বলেন, ‘‘আসলে এমসি কলেজের ঘটনার যদি বিচার হতো তাহলে জাঙ্গীরনগরের ঘটনা হয়তো ঘটত না৷ আমাদের এখানে এমসি কলেজের ঘটনায় দেখেছি বিচারহীনতা৷ আর এর পিছনে আছে ক্ষমতা৷ সাধারণ মানুষ বিচার পায় না৷ আবার বিচার এড়াতেও পারেন না৷ ক্ষমতাবানরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যান৷”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা মনে করেন,”বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনার সঙ্গে একটা পূর্বাপর সম্পর্ক আছে। এখানে এই ধরনের ঘটনা যখনই ঘটে তার সঙ্গে ক্ষমতার একটা সম্পর্ক থাকে৷ এর সঙ্গে একটি সিন্ডিকেট যুক্ত৷”
তিনি বলেন,”এর সঙ্গে প্রশাসন যুক্ত৷ বহিরাগতরা হলে থাকে তারা বের করে দেয় না কেন৷ আর যারা পালিয়ে গেল তারা কীভাবে পালালো? ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার একজনের একটি ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়েছে৷ সে নাকি এখানে নিয়োগ দেয়৷ তিনমাস আগে একটি বিশেষ ছাত্র সংগঠনের নেতারা ভিসি অফিসে তালা দেয় তাদের লোকজনকে নিয়োগ দেয়ার দাবিতে৷ তারা নিয়োগ বোর্ড বসতে দেয়নি৷”

তার কথা, ‘‘এগুলো একদিনের ঘটনা নয়৷ অনেক দিনের ঘটনার একটা জঘন্য প্রকাশ৷ এখন আপনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন৷ বহিষ্কার করছেন৷ কিন্তু এটা দিয়ে কি দায় এড়ানো যায়?

তারা বহুদিন ধরেই করছে

শনিবারের রাতের ঘটনার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিচারের দাবিতে প্রতিবাদী হয়৷ বিশেষ করে ধর্ষকদের পালানোর ভিডিও ভাইরাল হলে তারা ফুঁসে ওঠে৷ রীতিমত হলের একটি গেটের তালা ভেঙ্গে ধর্ষকেরা রাতে পালিয়ে যায়৷ ওই ঘটনায় শিক্ষার্থীরা হল প্রশাসনকে দায়ী করে৷ প্রতিবাদকারীদের একজন ড্রামা এন্ড ড্রামাটিকস-এর ছাত্র কনোজ কান্তি রায়৷ তিান বলেন,”ক্যাম্পাসে যারা বাইরে থেকে আসেন তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা ছিনতাই নিয়মিত ঘটনা৷ আরও অনেক অপকর্ম এখানে হয়৷ হলের সিট ভাড়া দেয়া হয় বাইরের লোকজনের কাছে৷ অনেকের এটা ব্যবসা৷  আবার পাস করার পরও ছাত্রলীগ নেতারা হলে থাকেন৷ তাই তারা মনে করেছেন এত কিছু করে যদি পার পাওয়া যায় তাহলে ধর্ষণ করলে কী হবে?”

‘‘তারা ক্ষমতার কারণেই এবং আগে কোনো শাস্তি না হওয়ায় এই কাজ করতে সাহসী হয়েছে,” বলেন এই শিক্ষার্থী৷

জাঙ্গীরনগর বিশববিদ্যলয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন বলেন,”আমরা ঘটনার পরই ব্যবস্থা নিয়েছি৷ এটা ব্যক্তির দায়৷ আর ছাত্রলীগের পরিচয়ে কেউ কিছু করলে তার দায় তো ছাত্রলীগ নেবে না৷” ক্যাম্পাসে সিট ভাড়াসহ আরো অনেক অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন,”যারা এখন আর ছাত্রলীগে নেই, পাস করে গেছেন৷ তারপরও হলে থাকলে তার দায় কে নেবে? তারা কীভাবে থাকেন আমরা জানি না।”

এটা এক ধরনের ক্ষমতার প্রকাশ

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বলেন, ‘‘এইরকম ধর্ষণের সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে৷ একটা হলো পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষের ক্ষমতা৷ আর তার সঙ্গে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকলে সাহস আরও বেড়ে যায়৷ বেপরোয়া হয়ে যায়৷ কোনো অপরাধ করলে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে দায় এড়ানো হয়৷  কিন্তু কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না৷ এমসি কলেজের ঘটনায় হয়নি৷ আরও অনেক ঘটনায় হয়নি৷ ফলে তারা বেপরোয়া হয়ে গেছে৷”

“জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা দলীয়ভাবে দায় অস্বীকার করার ফল৷ তারা মনে করে দলের কোনো দায় নেই৷ ওখানে তাদের অপকর্মের অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছিলো৷ তারা ক্ষমতার কারণে নিজেদের ধরাছোয়ার বাইরে মনে করে৷”
আর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা ঘটেছে আমি মনে করি তার কারণ ছাত্র রাজনীতিতে নেতিবাচক উপাদানের অনুপ্রবেশ যেমন সত্য তেমনি এটাকে শুধু দলীয়ভাবে না দেখে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে বাংলাদেশে নারীর সার্বিক সুরক্ষায় কাজ করা প্রয়োজন৷” ডয়চে ভেলে
Facebook Comments Box
ট্যাগস :

এমসি কলেজ থেকে জাহাঙ্গীরনগর

আপডেট সময় : ০৮:৩৬:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

জাহাঙ্গীরনগরের ঘটনা শনিবার রাতের৷ যে ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে তাদের মধ্যে দুইজন এখনো পলাতক৷ অভিযুক্তরা মীর মোশররফ হোসেন হলের ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নাম্বার কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে বেটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে ধর্ষণ করে৷ ধর্ষকদের একজন ওই দম্পতির পরিচিত হওয়ায় তারা কৌশলে তাদের বাইরে থেকে ডেকে আনে৷

এই ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের কেন্দ্রে রয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান৷ তার সঙ্গে ছিলেন একই বিভাগের সাগর সিদ্দিকী ও হাসানুজ্জামান এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান৷ পলাতক আছেন ভুক্তভোগীর পূর্বপরিচিত মো. মামুনুর রশিদ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক মুরাদ হোসেন৷

ছাত্র না হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থান এবং ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়া অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে৷ আর মূল হোতা ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানের কয়েকদিন আগের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়েছে৷ সেখানে তিনি দাবি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে তার হাত ছিলো৷

ছাত্রলীগের আরো দায়

সিলেট এমসি কলেজের শ্রীকান্ত ছাত্রাবাসে ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ধর্ষণ করে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী৷ ওই সময় কলেজ বন্ধ থাকলেও হলে থাকতেন জেলা আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরা৷ ঘটনার দিন আক্রান্ত নারী স্বামীকে নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে গিয়েছিলেন৷ রাত ৮টার দিতে তার স্বামী হোস্টেলের গেটে সিগারেট কিনতে  নামলে ধর্ষকেরা ওই নারীকে ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে৷ তার স্বামীকেও তারা আটকে রেখে মারধর করে৷

ওই ঘটনায় আট ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে তিন বছর আগে আদালতে চার্জশিট দেয়া হলেও এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি৷

এরকম আরও অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ ২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি গোপালগঞ্জের মকসুদপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নঈম কাজীর নেতৃত্বে চারজন এক তরুণীতে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে৷ মামলার দেড় মাস পর পুলিশ ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করে৷ ওই মামলায় এখনো চার্জশিট হয়নি বলে জানা গেছে৷

একই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি সাভার সদর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানা এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে৷ তার বিরুদ্ধে মামলা হলে চারদিন পর র‌্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে৷

গত ১৪ জানুয়ারি বাগেরহাটের ফফিরহাটে উপজেলা সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি শাকিল আহমেদ ও তার সহযোগীরা দুই তরুণীকে রাস্তা থেকে অপহরণ করে নিয়ে ধর্ষণ করে৷ পরে শাকিলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও তার সহযোগীরা পলাতক আছে৷

২০২৩ সালের ২৫ জুন রাতে রংপুরের পীরগঞ্জে এক গৃহবধুকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয় জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ইয়াসিন  আরাফাতের বিরুদ্ধে৷ ওই গৃহবধুকে জিম্মি করে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ৷ খোঁজ নিয়ে জানাগেছে ওই ছাত্রলীগ নেতা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি৷

২০১৯ সালে রংপুরের হারগাছা এলাকায় এক স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের পর তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় হারগাছার সারাই ইউনিয়নের ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ  সম্পাদক রাসেল মিয়া৷ পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷

এমসি কলেজ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সিলেট এমসি কলেজে নববধুকে ধর্ষণের ঘটনার পর ধর্ষকদের প্রশ্রয়দাতারা  ওই নারীর চরিত্রহননে নেমেছিল৷ কারণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা কলেজে কমিটি না থাকলেও তাদের দিয়ে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বাজয় রাখতেন৷ তিনি চেষ্টা করেছিলেন রাতেই ঘটনাটি মিটমাট করে ফেলতে৷ না পেরে ওই নেতা তাদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন৷ পরে অবশ্য পুলিশ তাদের আটক করে৷ কিন্তু তাদের বিচার এখানো হয়নি৷

ছাত্রলীগের আট নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে চার্জশিট ও অভিযোগ গঠন হলেও সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে না৷ গত তিন বছর ধরে সাক্ষীর জন্য ঝুলে আছে৷ আদৌ প্রভাবশালীদের চাপের মুখে সাক্ষী পাওয়া যাবে কী না সন্দেহ৷ এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার ও নারীর স্বামীকে হত্যারও হুমকি দেয়া হয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত বিচার কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারছেন না৷ সিলেটের নারী নেত্রী তামান্না আহমেদ বলেন, ‘‘আসলে এমসি কলেজের ঘটনার যদি বিচার হতো তাহলে জাঙ্গীরনগরের ঘটনা হয়তো ঘটত না৷ আমাদের এখানে এমসি কলেজের ঘটনায় দেখেছি বিচারহীনতা৷ আর এর পিছনে আছে ক্ষমতা৷ সাধারণ মানুষ বিচার পায় না৷ আবার বিচার এড়াতেও পারেন না৷ ক্ষমতাবানরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যান৷”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা মনে করেন,”বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনার সঙ্গে একটা পূর্বাপর সম্পর্ক আছে। এখানে এই ধরনের ঘটনা যখনই ঘটে তার সঙ্গে ক্ষমতার একটা সম্পর্ক থাকে৷ এর সঙ্গে একটি সিন্ডিকেট যুক্ত৷”
তিনি বলেন,”এর সঙ্গে প্রশাসন যুক্ত৷ বহিরাগতরা হলে থাকে তারা বের করে দেয় না কেন৷ আর যারা পালিয়ে গেল তারা কীভাবে পালালো? ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার একজনের একটি ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়েছে৷ সে নাকি এখানে নিয়োগ দেয়৷ তিনমাস আগে একটি বিশেষ ছাত্র সংগঠনের নেতারা ভিসি অফিসে তালা দেয় তাদের লোকজনকে নিয়োগ দেয়ার দাবিতে৷ তারা নিয়োগ বোর্ড বসতে দেয়নি৷”

তার কথা, ‘‘এগুলো একদিনের ঘটনা নয়৷ অনেক দিনের ঘটনার একটা জঘন্য প্রকাশ৷ এখন আপনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন৷ বহিষ্কার করছেন৷ কিন্তু এটা দিয়ে কি দায় এড়ানো যায়?

তারা বহুদিন ধরেই করছে

শনিবারের রাতের ঘটনার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিচারের দাবিতে প্রতিবাদী হয়৷ বিশেষ করে ধর্ষকদের পালানোর ভিডিও ভাইরাল হলে তারা ফুঁসে ওঠে৷ রীতিমত হলের একটি গেটের তালা ভেঙ্গে ধর্ষকেরা রাতে পালিয়ে যায়৷ ওই ঘটনায় শিক্ষার্থীরা হল প্রশাসনকে দায়ী করে৷ প্রতিবাদকারীদের একজন ড্রামা এন্ড ড্রামাটিকস-এর ছাত্র কনোজ কান্তি রায়৷ তিান বলেন,”ক্যাম্পাসে যারা বাইরে থেকে আসেন তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা ছিনতাই নিয়মিত ঘটনা৷ আরও অনেক অপকর্ম এখানে হয়৷ হলের সিট ভাড়া দেয়া হয় বাইরের লোকজনের কাছে৷ অনেকের এটা ব্যবসা৷  আবার পাস করার পরও ছাত্রলীগ নেতারা হলে থাকেন৷ তাই তারা মনে করেছেন এত কিছু করে যদি পার পাওয়া যায় তাহলে ধর্ষণ করলে কী হবে?”

‘‘তারা ক্ষমতার কারণেই এবং আগে কোনো শাস্তি না হওয়ায় এই কাজ করতে সাহসী হয়েছে,” বলেন এই শিক্ষার্থী৷

জাঙ্গীরনগর বিশববিদ্যলয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন বলেন,”আমরা ঘটনার পরই ব্যবস্থা নিয়েছি৷ এটা ব্যক্তির দায়৷ আর ছাত্রলীগের পরিচয়ে কেউ কিছু করলে তার দায় তো ছাত্রলীগ নেবে না৷” ক্যাম্পাসে সিট ভাড়াসহ আরো অনেক অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন,”যারা এখন আর ছাত্রলীগে নেই, পাস করে গেছেন৷ তারপরও হলে থাকলে তার দায় কে নেবে? তারা কীভাবে থাকেন আমরা জানি না।”

এটা এক ধরনের ক্ষমতার প্রকাশ

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বলেন, ‘‘এইরকম ধর্ষণের সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে৷ একটা হলো পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষের ক্ষমতা৷ আর তার সঙ্গে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকলে সাহস আরও বেড়ে যায়৷ বেপরোয়া হয়ে যায়৷ কোনো অপরাধ করলে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে দায় এড়ানো হয়৷  কিন্তু কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না৷ এমসি কলেজের ঘটনায় হয়নি৷ আরও অনেক ঘটনায় হয়নি৷ ফলে তারা বেপরোয়া হয়ে গেছে৷”

“জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা দলীয়ভাবে দায় অস্বীকার করার ফল৷ তারা মনে করে দলের কোনো দায় নেই৷ ওখানে তাদের অপকর্মের অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছিলো৷ তারা ক্ষমতার কারণে নিজেদের ধরাছোয়ার বাইরে মনে করে৷”
আর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা ঘটেছে আমি মনে করি তার কারণ ছাত্র রাজনীতিতে নেতিবাচক উপাদানের অনুপ্রবেশ যেমন সত্য তেমনি এটাকে শুধু দলীয়ভাবে না দেখে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে বাংলাদেশে নারীর সার্বিক সুরক্ষায় কাজ করা প্রয়োজন৷” ডয়চে ভেলে
Facebook Comments Box