ঢাকা ০৭:২৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ অক্টোবর ২০২৪, ৬ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারিয়ে যেতে বসেছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মাতৃভাষা, রক্ষায় জোর প্রচেষ্টার দাবী

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় : ১০:৩০:৪০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ৪৬ বার পঠিত

জাতিগত ও ভাষা বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। ৫৪টির বেশি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস এখানে। তবে ভাষা রয়েছে বাংলাসহ ৪১টি। এরমধ্যে ৩৪টি ভাষাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির । কিন্তু বৈচিত্র্যের বাস্তবতা বেশ সঙ্গীন। কেন না ক্ষুদ্র নূগোষ্ঠীর ভাষায় পড়াশুনা করার বা কথা বলার সুযোগ না থাকায় এটা হারিয়ে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টেটিউটের তথ্য অনুযায়ী, সুনির্দিষ্টভাবে বিপন্ন ভাষার সংখ্যা বললে তা ১৪টি। রেংমিটাচা  ৪০ জন, কডা ৬০০-৭০০জন, কন্দ ৬০০-৭০০ জন, লুসাই ৯৫৯ জন, খাড়িয়া ১০০০ জন, সৌরা ১০০০ জন, লালেং বা পাত্র ২০৩৩ জন, পাংখোয়া ২২৭৪ জন, চাক ২৮৩৫, কোল ২৮৪৩ জন, খুমি ৩৩৬৯জন, খিয়াং ৩৮৯৯ জন, মালতো ৮০০০ জন, মুন্ডারি ৩৮২১২। এগুলো সবই ২০১৮ সালের ন ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার তথ্য এবং অনেক ক্ষেত্রেই ইনস্টিটিউট তথ্যগুলো পেয়েছে ২০১১ সালের আদমশুমারি থেকে। অর্থাৎ তথ্যগুলো বেশ পুরনো। পরবর্তীত আর কোন সমীক্ষা হয়নি। ভাষাগুলো নিজেদের মতো করে টিকে থাকতে পারছে না।

মাঠ পর্যায়ের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, শেরপুরে, হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি। পরিবারের চর্চা কমে যাওয়া ও নিজস্ব ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায়, এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তারা।

জেলার শ্রীবরদী,ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তজুড়ে, সাতটি সম্প্রদায়ের ৬০ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। এরমধ্যে গারো,বর্মণ,কোচ ও হদি সম্প্রদায়ের সংখ্যাই বেশি। একসময় সমৃদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতি থাকলেও,সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে, নিজেদের চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে, ভুলতে বসেছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি।

এদের একটি অংশ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে;অল্প কিছু স্কুলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ধরে রাখার চেষ্টা করা হলেও, শিক্ষক সংকট দীর্ঘদিনের। তাই ভাষা ধরে রাখতে, প্রতিটি স্কুলে বইয়ের পাশাপাশি, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিক্ষক নিয়োগ ও একটি কালচারাল একাডেমি স্থাপনের দাবি তাদের। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে, একযোগে কাজ করার কথা জানান আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্প,আইইডির ফেলো সুমন্ত বর্মণ।

শেরপুরের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো: ওবায়দুল্লাহ শিক্ষক সংকটের কথা বললেও জেলা প্রশাসক আব্দুল্লাহ আল খায়রুম বলেন, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে শেরপুর জেলায় ২৬ হাজার গারো,বর্মণ ২২ হাজার, কোচ ৪ হাজার, হাজং ৩ হাজার, হদি ৩ হাজার ৫শ,ডালু ১৫০০ এবং  ১৫০জন বানাই সম্প্রদায় বসবাস করছেন।

এদিকে, মৌলভীবাজার চা বাগানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতিসত্তা খাড়িয়া। তাদের মাতৃভাষার নামও খাড়িয়া। চা শিল্পাঞ্চলে কর্মরত অসংখ্য খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর প্রাণের ভাষা ছিল এটি। কিন্তু সময়ের গতিধারায় চা বাগান থেকে ভাষাটি হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন মাত্র দুই নারী ৮০ বছর বয়সি ভেরোনিকা কেরকেটা ও ৭৫ বছর বয়সি খ্রিস্টিনা কেরকেটা। আদি খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন। সম্পর্কে দুই বোন। এরা বহু আগেই জাত-পাত, সংস্কৃতি, ভাষায় বৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলাদেশের একটি ভাষার শেষ প্রতিনিধি। এই দুইজন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খাসি, কোড়া, পাংখুয়া, খাড়িয়া, সৌরা, কোডা, মুন্ডারি, মালতো, কন্দ, খুমি, রেংমিতচা, খিয়াং, পাত্র ও লুসাই ভাষা সহ ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। এসব ভাষাগুলো ব্যবহার করা লোকের সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ করে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট চা বাগানের বর্মাছড়ায় ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা দুই বোন খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন। তাদের পরিবারের সদস্য ও খাড়িয়া সম্প্রদায়ের কোনো মানুষের ভাষাটি সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান নেই। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রকৃত ভাষা খাড়িয়া।

মাংরা বস্তীর খাড়িয়া সম্প্রদায়ে জহরলাল ইন্দোয়ার সামান্য খাড়িয়া ভাষা বলতে পারেন। তার সঙ্গে কথা হলে, তিনি বলেন খাড়িয়া ভাষা ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ভারতের রাচিতে খাড়িয়া ভাষার বহুল প্রচলিত। আমাদের পূর্বপুরুষ যারা রাচি থেকে এদেশে চা বাগানে নিয়ে আসা হলে সে সময়ে এই ভাষার ব্যাপক প্রচলন ছিল। চা বাগানগুলোর মধ্যে বহু ভাষাভাষী মানুষের বসবাস।অবহেলিত জনগোষ্ঠী হিসেবে চা বাগানের অনেকগুলো ভাষা সংরক্ষণ ও পরিচর্চার অভাবে আজ বিপন্ন।

খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম মিশ্রণ বাংলায় কথা বলে অভ্যস্ত। বাংলায় লেখা পড়ার কারণে তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না। তবে মাতৃভাষা সংরক্ষণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ আবশ্যক বলে দাবি তাদের।

Facebook Comments Box
ট্যাগস :

হারিয়ে যেতে বসেছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মাতৃভাষা, রক্ষায় জোর প্রচেষ্টার দাবী

আপডেট সময় : ১০:৩০:৪০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

জাতিগত ও ভাষা বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। ৫৪টির বেশি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস এখানে। তবে ভাষা রয়েছে বাংলাসহ ৪১টি। এরমধ্যে ৩৪টি ভাষাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির । কিন্তু বৈচিত্র্যের বাস্তবতা বেশ সঙ্গীন। কেন না ক্ষুদ্র নূগোষ্ঠীর ভাষায় পড়াশুনা করার বা কথা বলার সুযোগ না থাকায় এটা হারিয়ে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টেটিউটের তথ্য অনুযায়ী, সুনির্দিষ্টভাবে বিপন্ন ভাষার সংখ্যা বললে তা ১৪টি। রেংমিটাচা  ৪০ জন, কডা ৬০০-৭০০জন, কন্দ ৬০০-৭০০ জন, লুসাই ৯৫৯ জন, খাড়িয়া ১০০০ জন, সৌরা ১০০০ জন, লালেং বা পাত্র ২০৩৩ জন, পাংখোয়া ২২৭৪ জন, চাক ২৮৩৫, কোল ২৮৪৩ জন, খুমি ৩৩৬৯জন, খিয়াং ৩৮৯৯ জন, মালতো ৮০০০ জন, মুন্ডারি ৩৮২১২। এগুলো সবই ২০১৮ সালের ন ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার তথ্য এবং অনেক ক্ষেত্রেই ইনস্টিটিউট তথ্যগুলো পেয়েছে ২০১১ সালের আদমশুমারি থেকে। অর্থাৎ তথ্যগুলো বেশ পুরনো। পরবর্তীত আর কোন সমীক্ষা হয়নি। ভাষাগুলো নিজেদের মতো করে টিকে থাকতে পারছে না।

মাঠ পর্যায়ের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, শেরপুরে, হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি। পরিবারের চর্চা কমে যাওয়া ও নিজস্ব ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায়, এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তারা।

জেলার শ্রীবরদী,ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তজুড়ে, সাতটি সম্প্রদায়ের ৬০ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। এরমধ্যে গারো,বর্মণ,কোচ ও হদি সম্প্রদায়ের সংখ্যাই বেশি। একসময় সমৃদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতি থাকলেও,সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে, নিজেদের চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে, ভুলতে বসেছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি।

এদের একটি অংশ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে;অল্প কিছু স্কুলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ধরে রাখার চেষ্টা করা হলেও, শিক্ষক সংকট দীর্ঘদিনের। তাই ভাষা ধরে রাখতে, প্রতিটি স্কুলে বইয়ের পাশাপাশি, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিক্ষক নিয়োগ ও একটি কালচারাল একাডেমি স্থাপনের দাবি তাদের। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে, একযোগে কাজ করার কথা জানান আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্প,আইইডির ফেলো সুমন্ত বর্মণ।

শেরপুরের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো: ওবায়দুল্লাহ শিক্ষক সংকটের কথা বললেও জেলা প্রশাসক আব্দুল্লাহ আল খায়রুম বলেন, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে শেরপুর জেলায় ২৬ হাজার গারো,বর্মণ ২২ হাজার, কোচ ৪ হাজার, হাজং ৩ হাজার, হদি ৩ হাজার ৫শ,ডালু ১৫০০ এবং  ১৫০জন বানাই সম্প্রদায় বসবাস করছেন।

এদিকে, মৌলভীবাজার চা বাগানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতিসত্তা খাড়িয়া। তাদের মাতৃভাষার নামও খাড়িয়া। চা শিল্পাঞ্চলে কর্মরত অসংখ্য খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর প্রাণের ভাষা ছিল এটি। কিন্তু সময়ের গতিধারায় চা বাগান থেকে ভাষাটি হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন মাত্র দুই নারী ৮০ বছর বয়সি ভেরোনিকা কেরকেটা ও ৭৫ বছর বয়সি খ্রিস্টিনা কেরকেটা। আদি খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন। সম্পর্কে দুই বোন। এরা বহু আগেই জাত-পাত, সংস্কৃতি, ভাষায় বৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলাদেশের একটি ভাষার শেষ প্রতিনিধি। এই দুইজন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খাসি, কোড়া, পাংখুয়া, খাড়িয়া, সৌরা, কোডা, মুন্ডারি, মালতো, কন্দ, খুমি, রেংমিতচা, খিয়াং, পাত্র ও লুসাই ভাষা সহ ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। এসব ভাষাগুলো ব্যবহার করা লোকের সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ করে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট চা বাগানের বর্মাছড়ায় ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা দুই বোন খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন। তাদের পরিবারের সদস্য ও খাড়িয়া সম্প্রদায়ের কোনো মানুষের ভাষাটি সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান নেই। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রকৃত ভাষা খাড়িয়া।

মাংরা বস্তীর খাড়িয়া সম্প্রদায়ে জহরলাল ইন্দোয়ার সামান্য খাড়িয়া ভাষা বলতে পারেন। তার সঙ্গে কথা হলে, তিনি বলেন খাড়িয়া ভাষা ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ভারতের রাচিতে খাড়িয়া ভাষার বহুল প্রচলিত। আমাদের পূর্বপুরুষ যারা রাচি থেকে এদেশে চা বাগানে নিয়ে আসা হলে সে সময়ে এই ভাষার ব্যাপক প্রচলন ছিল। চা বাগানগুলোর মধ্যে বহু ভাষাভাষী মানুষের বসবাস।অবহেলিত জনগোষ্ঠী হিসেবে চা বাগানের অনেকগুলো ভাষা সংরক্ষণ ও পরিচর্চার অভাবে আজ বিপন্ন।

খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম মিশ্রণ বাংলায় কথা বলে অভ্যস্ত। বাংলায় লেখা পড়ার কারণে তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না। তবে মাতৃভাষা সংরক্ষণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ আবশ্যক বলে দাবি তাদের।

Facebook Comments Box