২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ৩৩টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দলটি যেহেতু ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছে, সেজন্য এসব প্রতিশ্রতির মধ্যে কিছু ছিল পুরনো প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতা। তবে নতুন কিছু প্রতিশ্রুতিও আসে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে।
‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে ইশতেহারে যা ছিল, সেগুলো তারা বিস্তারিত তুলে ধরেছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনের ইশহেতারে যেসব কথা বলা হয়েছিল তার মধ্যে বেশ কিছু নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্ক আছে। কিছু প্রতিশ্রুতি তারা পূরণ করতে পেরেছে, কিছু পারেনি। এই লেখায় ইশতেহারের আলোচিত কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।
মোট প্রতিশ্রুতি: ১২
গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার সাথে রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনের সবক্ষেত্রে উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। “গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ নির্বাচন”- ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে এভাবেই বর্ণনা করেছিল। বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হবে এবং সংবিধান হবে রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ দলিল।
গত পাঁচ বছরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংসদীয় আসনে উপ-নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু সেসব নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। খোদ ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরপর বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২২ সালের গণতন্ত্র সূচকে ''হাইব্রিড রেজিম'' বা মিশ্র শাসনের দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। সাধারণত সেইসব দেশকে হাইব্রিড রেজিম বলে বর্ণনা করা হয় যেসব দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা রয়েছে, কিন্তু সেখানে নিয়মিত নির্বাচন হলেও রাজনৈতিক দমন পীড়নও চলে। অর্থাৎ এসব দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, আইনের শাসনের মূল বক্তব্যই হচ্ছে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা হবে। এছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে কোন প্রচেষ্টা প্রতিহত করার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা হবে। মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছিল।
গত পাঁচ বছরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল সরকার। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে যে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় উঠে আসে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেনা। বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের উপর মাত্রাতিরিক্ত ও অবৈধ শক্তি প্রয়োগের বিষয়গুলো তদন্ত করা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব কর্মকর্তা এর সাথে জড়িত তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার সুপারিশ করছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছিল। ইশতেহারে বলা হয়েছিল, দুর্নীতি দমন কমিশনকে কর্ম পরিবেশ ও দক্ষতার দিকে থেকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করা হবে। এছাড়া ঘুষ, অনুপার্জিত আয়, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, ঋণ-খেলাপি, পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আওয়ামী লীগ সাফল্য অর্জনের দাবি করছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল সেগুলো পূরণের ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতে রয়ে গেছে। ২০২৩ সালের শুরুতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির যে ধারণা সূচক প্রকাশ করেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭ নম্বরে।
প্রতিবেদন অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান কেবল আফগানিস্তানের ওপরে। এছাড়া বিভিন্ন সময় টিআইবি সরকারি সংস্থাগুলোর উপর যেসব গবেষণা করেছে সেখানে দুর্নীতির ব্যাপকতার চিত্র উঠে এসেছে। এছাড়া টিআইবি বলেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ নয়।
আগামীতে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির প্রতি সরকারের দৃঢ় অবস্থান থাকবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, জঙ্গিবাদ দমনে সরকার সাফল্য দেখিয়েছে। যদিও বিভিন্ন সময় জঙ্গি বিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে সন্দেহভাজন অনেকেই নিহত হয়েছে। ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পরে বাংলাদেশের সে অর্থে আর জঙ্গি হামলা দেখা যায়নি।
তার আগে একের পর এক ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছিল। কিন্তু এসব ঘটনা ২০১৮ সালের পর থেকে আর ঘটেনি। জঙ্গিবাদ দমনের জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধিতে অনেক ধরনের কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। পুলিশ বাহিনীতে বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি এবং শুধু জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করার জন্য নতুন ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, দুই মেয়াদে ১০ বছর বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বর্তমানে উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে সাফল্য ও অর্জন, তা দেশের ইতিহাসে অনন্য এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে অনুকরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর লক্ষ্য অর্জন করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতার ৭০ বছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। এজন্য বেশ কিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
যেমন, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল সাত দশমিক ৮৬ শতাংশ , যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১০ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। একইভাবে, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১৭৫১ মার্কিন ডলার, যা পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে ২৭৫০ মার্কিন ডলার হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সেসময় ছিল ৩৪ বিলিয়ন ডলার, যেটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার হবে বলা হয়। আবার রপ্তানি আয় যেখানে ছিল ৩৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার, সেটি ৭২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার অঙ্গীকার করা হয়।
এছাড়া দরিদ্র জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার সাড়ে ২১ শতাংশ, যেটি চলতি অর্থবছরের মধ্যে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। আর সবশেষ ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখার সফলতা দাবি করো হয়েছিল ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও সেটি পূরণ করতে পারেনি। সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৭.৫ শতাংশ। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছিল জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশ হতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক পর্যায়ে বৃদ্ধির পরে ব্যাপকভাবে কমেছে। ২০২৩ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও, নভেম্বর মাসের শেষ নাগাদ বাংলাদেশের নেট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ১৯ বিলিয়ন ডলারে। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৭২ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু এর আগের বছর রপ্তানি আয় হয়েছে প্রায় ৫৬ বিলিয়ন ডলার। আগামী এক বছরের মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে কী না, সেটি নিয়ে সংশয় আছে। যদিও ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি আয় বেড়েছে।
সরকার দাবি করছে, মাথাপিছু আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি তারা অর্জন করতে পেরেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখা যায়নি। গত দেড় বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। ডলার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
ব্যাংক, বীমা খাতের সম্প্রসারণ, দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ অধিকতর কার্যকর ও শক্তিশালী করা হবে। ঋণসহ ব্যাংক জালিয়াতি কঠোর হস্তে দমন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঋণ গ্রাহক ও দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছিল।
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা প্রকট হয়েছে। খেলাপি ঋণের হার বৃদ্ধি, তারল্য সংকট, জালিয়াতি, ব্যাংকে রাজনৈতিক প্রভাব – এসব সমস্যা বড় আকার ধারণ করেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছিল। যা মোট প্রদত্ত ঋণের নয় দশমিক ৩৬ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, কোনো দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই থেকে তিন শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিলে এক লাখ দেড় হাজার কোটি টাকা। এই হিসাব অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৩২ হাজার কোটি টাকা। শতকরার হিসাবে এটি ৩২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এসব ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের ২৩ শতাংশই খেলাপি। আর বেসরকারি ব্যাংকে এই পরিমাণ আরো বেশি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে কেন? এ বিষয়টি অর্থ মন্ত্রনালয়ের কাছে জানতে চেয়েছিল আইএমএফ। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ইসলামী ব্যাংক থেকে আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৭০০০ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি যে কোন দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন অগ্রযাত্রার একটি অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুগান্তকারী পরিকল্পনা ও কর্মসূচী প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। ২০২৩ সালের মধ্যে ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ২৩ হাজার কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে সকলের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। মহেশখালী ও মাতারবাড়ী অঞ্চলে একটি এবং পায়রাতে একটি করে ‘এনার্জি হাব’ গড়ে তোলা হবে। বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অধিকতর কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
বর্তমান সরকারের সফলতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো। ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বাংলাদেশের এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। সেই সঙ্গে আমদানি হয় এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম কেন্দ্র রয়েছে ১৫৪টি। যার মধ্যে বেশিরভাগই ভাড়ায় চালিত ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কিন্তু ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়া আর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে গত বছর তীব্র চাহিদার সময়েও ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা হয়। বিদ্যুৎ খাতে একটি বড় সমালোচনা ও বোঝা ছিল ক্যাপাসিটি চার্জ। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৪ বছরে ৮২টি বেসরকারি এবং ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ মোট এক লাখ চার হাজার ৯২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে বলে সংসদকে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়নি। বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানও কার্যত বন্ধ রয়েছে। ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্র-বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও বঙ্গোপসাগরে এখনো কোন অনুসন্ধান কূপ খনন করতে পারেনি বাংলাদেশ। সাগরে এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হওয়া একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গুও পরিত্যক্ত হয়েছে।
বিদেশে অর্থ বা পুঁজি পাচার ও সম্পদ গচ্ছিত রাখা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং অপরাধ দৃঢ়ভাবে দমনে সক্রিয় থাকছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট একটি স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে বিশ্বসংস্থা ও বিদেশি সংস্থাসমূহের সাথে যোগাযোগ রাখছে। অর্থ পাচার রোধে সকল কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার থামানো যায়নি গত পাঁচ বছরে। উল্টো এটা বেড়েছে বলে বিভিন্ন রিপোর্টে উঠে এসেছে। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়, টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। সাত বছরে এভাবে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। ২০২২ সালে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের পরিমাণ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় আট হাজার দু'শ ৭৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে, এই অর্থের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার তিনশ ৪৭ কোটি টাকা।
দেশের উন্নয়নে নতুন গতি সঞ্চারের জন্য বড় ধরণের বিনিয়োগ প্রকল্পের প্রয়োজন অপরিহার্য। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে – পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর, মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, পায়রা সমুদ্র বন্দর, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ১২৯ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন এবং ঢাকায় মেট্রোরেল। এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি হবে এবং সেই সাথে মানুষের কর্মসংস্থান, আয় ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে বহুগুণ।
অবকাঠামো উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকার সাফল্য দেখিয়েছে। প্রতিশ্রুত মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে কয়েকটির কাজ ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই চলমান ছিল। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস নাগাদ অধিকাংশ অবকাঠামোর উদ্বোধন হয়েছে। যদিও অনেক প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যেমন বেড়েছে, তেমনি খরচও বেড়েছে অনেক। নির্বাচনের ইশতেহারে বলা হয়েছিল, মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ডিসেম্বর ২০১৯ এবং মতিঝিল পর্যন্ত ২০২০ সালে শেষ হবে। কিন্তু এই প্রকল্প শেষ করতে আরো তিন বছর বেশি সময় লেগেছে। বলা হয়েছিল, ২০২৪ সালের মধ্যে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্র ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। কিন্তু এই বিদ্যুৎ-কেন্দ্র পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতায় চালু হবে ২০২৬ সালে।
সামনের দিনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ডিজিটাল যুগে বিশ্ব পরিমণ্ডলে সামনের কাতারে থাকা। ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার বাস্তবতা ইতোমধ্যে সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান করা সম্ভব হয়েছে। ২০২১-২৩ সালের মধ্যে ফাইভ-জি চালু করা হবে। ই-পাসপোর্ট ও ই-ভিসা চালু করা হবে। আর্থিক খাতের লেনদেন ডিজিটাল করা হবে। তথ্যপ্রযুক্তির সফটওয়্যার, সেবা ও ডিজিটাল যন্ত্রের রপ্তানি সাত বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যবহারের মূল্য যুক্তিসংগত পর্যায়ে নামিয়ে আনা হবে।
বাংলাদেশ ফো-জি সেবা চালু করতে পারলেও ফাইভ-জি এখনো চালু করতে পারেনি। তাছাড়া ফোর-জি সেবা কাঙ্ক্ষিত মানের নয় বলে গ্রাহকদের অভিযোগ রয়েছে। ই-পার্সপোর্ট দেবার কাজ শুরু হয়েছে এ সময়ের মধ্যে। এছাড়া আর্থিক খাতের লেনদের বড় একটি অংশ ডিজিটাইজ হয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেটের মূল্য খুব একটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়নি সরকার।
আওয়ামী লীগ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের অধিকার সুরক্ষায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। ৩৩টি টেলিভিশন চ্যানেল (৪৪টি লাইেসন্সপ্রাপ্ত), ১৬টি এফএম রেডিও (২৮টি লাইসেন্স প্রাপ্ত), ১৭টি কমিউনিটি রেডিও ( ৩২টি লাইসেন্স প্রাপ্ত) এবং অসংখ্য সংবাদপত্র ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে দেশে তথ্যের অবাধ চলাচল অব্যাহত আছে। সাংবাদিকতা পেশা ও স্বাধীনভাবে তথ্য সরবরাহে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট যেন কিছুতেই বাধা না হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনা করে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
গণমাধ্যমে সংখ্যা বাড়লেও তারা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে সে প্রশ্ন রয়ে গেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত কয়েক বছরে সাংবাদিক, রাজনীতিক, শিল্পী, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, গার্মেন্টস-কর্মী থেকে শিক্ষক ছাত্র পর্যন্ত অনেক মানুষ আসামী হয়ে জেল খেটেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও রাষ্ট্রের চাপে সরকার ২০২৩ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কিছু ধারা পরিবর্তন করে সাইবার সিকিউরিটি আইন করেছে। বিভিন্ন সংগঠন বলছে, আইনের নাম পরিবর্তন হলেও সেটি নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে। ট
জন-বান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তোলা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে জনমনে ভীতি দূর করে একটি জন-বান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। আগামী পাঁচ বছরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে নিয়োগ করা হবে এবং তাদের আধুনিক করার কাজ অব্যাহত থাকবে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও দেশের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েই গেছে। জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী কমিটির মতে সন্দেহভাজন জঙ্গি এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য লোহার রড দিয়ে মারধর, হাঁটুতে গুলি করা ও বৈদ্যুতিক শক দেবার মতো নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
সম্পাদক : মাহমুদ আনোয়ার হোসেন
নির্বাহী সম্পাদক : জুবায়ের রহমান চৌধুরী
বার্তা সম্পাদক : খালেকুজ্জামান পান্নু
বার্তা ও সম্পাদকীয় কার্যালয় : বাড়ি # ৬৩, সড়ক # ২১,
রূপনগর আ/এ, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬।
বাণিজ্যিক কার্যালয় : গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড, ঢাকা-১২১২।
ফোন : 01731-488397,01552381515, 01751345643
হোয়াটসএ্যাপ : 01826567123
Copyright © 2024 সারাবেলার সংবাদ. All rights reserved.