বেদখল বাড়ি ফিরে পাওয়ার অনিঃশেষ লড়াই
- আপডেট সময় : ০১:২৮:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ মার্চ ২০২৪ ১৭২ বার পঠিত
রাজধানীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বহু বাড়ি এখনও প্রভাবশালীদের দখলে৷ অনেকেই ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বৈধ মালিক সেজে বসে আছেন।কিছু বাড়ি আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও দখলমুক্ত হচ্ছে না৷
সম্প্রতি ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদীকে গুলশানের একটি বাড়িতিন মাসের মধ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। এর আগে সাংবাদিক আবেদ খানের একটি বাড়িও রাষ্ট্রের কাছে বুঝিয়ে দিতে বলেছে আদালত। এলিফ্যান্ট রোডে সরকারি একটি বাড়িতে এক সাবেক অতিরিক্ত সচিবের থাকার বিষয়টিও উঠে আসে খবরে। বাড়ি থেকে তাকে উচ্ছেদ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয় কর্মকর্তাদের।
দখল হওয়া বাড়িগুলো উদ্ধার করার জন্য ২০২০ সালের জুন মাসে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে ৫ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সেই কমিটি দৃশ্যত কোনো কাজই করেনি। বর্তমানে এ কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ-১) সৈয়দ মামুনুল আলম। তিনি ২০২৩ সালের ১১ জুলাই এ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ৪টি সভা করেছে তারা।
সৈয়দ মামুনুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এই বাড়িগুলো আসলে এভাবে উদ্ধার হবে না। আদালত থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে। আমরা উদ্ধার করতে গিয়ে দেখেছি, তারা কাগজপত্র দেখায়। এখন সবার কাগজই আমাদের কাছে বৈধ মনে হয়। সেই ১৯৬০-৬৫ সাল থেকে তারা দখল করে রেখেছেন। এমনকি স্বাধীনতার পর থেকেও অনেকে দখলে রেখে কাগজপত্র তৈরি করেছেন। ফলে শুধু আমরা গিয়েই তাদের উচ্ছেদ করে দিতে পারছি না। এগুলো উদ্ধারের জন্য আমার মনে হয় আদালত থেকেই সিদ্ধান্ত আসতে হবে।”
ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীদের দখলে আছে ৩৯টি বাড়ি। তবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী এমন বাড়ির সংখ্যা ৩১। শত শত কোটি টাকার এই সম্পত্তি সাবেক সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ, মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ী, সাবেক সচিব বা রাজনীতিবিদদের নামে দখল করে রাখা হয়েছে। অনেক জমিতে বানানো হয়েছে বহুতল ভবন। জানা গেছে, অভিজাত এলাকায় বেহাত হওয়া সরকারি বাড়ি দখলমুক্ত করতে প্রায় চার বছর আগে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টো কমিটি গঠনের পর গত ৪ বছরে নতুন করে বেদখল হয়েছে আরও বেশ কিছু বাড়ি।
রাজউকের পরিচালক (এস্টেট) নুরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমাদের বেদখল হওয়া বাড়ি বা জমির খবর আমরা পেলে সেগুলো উদ্ধারে অভিযান চালাই। উদ্ধার করে যার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাকে বুঝিয়ে দেই। আর যে বাড়িগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে, সেগুলো আসলে পাকিস্তানিদের ছিল। তারা চলে যাওয়ার পর রাষ্ট্রের অনূকূলে বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ফলে এই বাড়িগুলোর মালিক গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। তারা উদ্ধারে কাজ করতে পারে। এখানে রাজউকের কিছু করার নেই। আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি।”
কথিত দখলকৃত এই বাড়িগুলো গত ৫২ বছরে বহুবার হাতবদল হয়েছে। দীর্ঘদিনের অনাদর, অবহেলা ও সংস্কারের অভাবে কিছু বাড়ি বসবাসের উপযোগিতা হারিয়েছে।
বাড়িগুলোর প্রসঙ্গে প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের লোকজনের সঙ্গে যোগসাজস করেই তো এগুলো বেদখল হয়েছে। দখলদার তো আর একা নয়। এই বাড়িগুলো উদ্ধার করার জন্য যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদেরও গাফিলতি রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করার জন্যই তারা বেতনভুক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারি। এই দায়িত্ব যদি প্রতিপালন করতে তারা না পারেন, তাহলে তো জবাবদিহি থাকতে হবে।”
অবসরে যাওয়ার পরও সাড়ে পাঁচ বছর ধরে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে সরকারি একটি বাড়িতে থাকছেন একজন অতিরিক্ত সচিব। এরই মধ্যে তার কাছে বাড়িভাড়া বাবদ ৩০ লাখ টাকারও বেশি পাওনা জমেছে। এ অবস্থায় গত মাসে এই কর্মকর্তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদে অভিযান চালায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। তবে অভিযানের মাঝপথে ফিরে আসতে হয় কর্মকর্তাদের। এলিফ্যান্ট রোডের ৩৩১ নম্বর দোতলা বাড়িটি ১০ কাঠার ওপর নির্মিত৷ বাড়িটির দখলে আছেন সাবেক এই অতিরিক্ত সচিবে আশরাফুল ইসলাম। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের পরিচালক ছিলেন। ওই সময়ই তিনি ওই বাড়িতে ওঠেন। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বলছে, তাকে বাড়িটি ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হলেও তিনি এতে সাড়া দেননি। মন্ত্রণালয়ের এক আবেদনের ভিত্তিতে এখনও ওই বাড়িতে আছেন তিনি।
আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এভাবে বাড়িগুলো উদ্ধার হবে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করেই তারা বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন বা দখলে রেখেছেন। অনেকে আদালত থেকে রায়ও নিয়েছেন। এখন সরকারের এর বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে। সেই আগ্রহ তাদের নেই। এখন এই বাড়িগুলো উদ্ধার করতে হলে একটা কমিশন করতে হবে। সেই কমিশন কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। আদালতে যেতে হলে তারা যাবে। সরকারের যদি আগ্রহ থাকে, তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকার এই সম্পদ উদ্ধার করা সম্ভব।”
সর্বশেষ আলোচনায় আসা খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে তিন মাসের মধ্যে গুলশানের বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। তিন মাসের মধ্যে বাড়িটি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বরাবর হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। জনস্বার্থে করা একটি রিট আবেদনের দীর্ঘ শুনানি শেষে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণা করেন। সালাম মুর্শেদীর দখলে থাকা গুলশান-২ এর ১০৪ নম্বর সড়কের ২৯ নম্বর বাড়িটি ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি’ দাবি করে তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর সেই আবেদনে দুদক, রাজউক ও গণপূর্ত বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের সেখানে বিবাদী করা হয়। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২২ সালের ১ নভেম্বর রুল জারি করে হাই কোর্টের এই বেঞ্চ। ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাড়িটি নিয়ে রাজউকের প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করে বলা হয়, বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকায় নেই। ওই বাড়ির নকশাও (মূল লে আউট প্ল্যান) আদালতে জমা দেয় রাজউক। অবশেষে বাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এলো।
এর আগে সাংবাদিক আবেদ খানের দাবি করা ধানমন্ডির ৩০০ কোটি টাকার বাড়িটির মালিকানা সরকারের মর্মে রায় ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদনের শুনানি শেষে গত বছরের ১৫ মে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ রায় দেন। এর আগে ২০১৭ সালের জুন মাসে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক উপ রাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে গুলশান এভিনিউর ১৫৯ নম্বর বাড়ি থেকে চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদ করা হয়। ৩৬ বছর ধরে গুলশানের পরিবার-পরিজন নিয়ে ওই বাড়িতে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর অভিযান চালিয়ে বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক। ডয়চে ভেলে