ভোক্তার অধিকার রক্ষায় কী করছে ভোক্তা অধিদপ্তর
- আপডেট সময় : ০২:৪০:১৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ মার্চ ২০২৪ ৩২ বার পঠিত
বাংলাদেশে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরই মূল দায়িত্বে আছে৷ কিন্তু তাদের জনবল আর কর্মএলাকার সীমবদ্ধতার কারণে ভোক্তারা সব অভিযোগের প্রতিকার পান না৷
২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন পাস হয়৷ এই আইনের অধীনে অধিদপ্তর বাজার তদারকি, ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ এবং এই সংক্রান্ত অপরাধের বিচার ও নিস্পত্তি করে৷
তাদের কাজের মূল উদ্দেশ্য হলো ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্যক্রম প্রতিরোধ এবং অভিযোগ নিস্পত্তির মাধ্যমে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ৷
তবে আইনে ই-কমার্স, স্বাস্থ্যসেবা, টেলিকম, বাড়িভাড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত নেই৷ সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যেমনওয়াসা, ডেসা বা তিতাসের গ্রাহকদের কোনো অভিযোগ আমলে নিতে পারে না ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর৷ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ আসে অধিদপ্তরে৷
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানান, ‘‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আইনে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও আমরা প্রতারণাসহ অন্য আইনে অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করি৷”
অধিদপ্তর যেভাবে কাজ করে
ভোক্তারা সরাসরি ও অনলাইনে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারেন৷ তারা অভিযানও পরিচালনা করে৷ এটা অভিযোগের ভিত্তিতেও হয় আবার অধিদপ্তর নিজেদের উদ্যোগেও করে৷ অভিযানের ক্ষেত্রে অন্যায্য দাম, প্রতারণা, ভেজাল ও মজুতের মতো বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়৷
ভোক্তা সংরক্ষণ অধিকার আইন অনুযায়ী অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা এবং বিচারিক কাজ দুইটিই এক সঙ্গে করে৷ আইনের ৭০ ধারায় তারা প্রশাসনিক ব্যবস্থার আওতায় জরিমানা, লাইসেন্স বাতিল, স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে কার্যক্রম বন্ধ করতে পারে৷ আইনের ৫৭ ধারায় ফৌজদারী ব্যবস্থা নিতে পারে৷ সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা দুইলাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দিতে পারে৷ তারা আইনের ৬৬-৬৭ ধারায় ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারে৷ ক্ষতির চেয়ে পাঁচগুণ পরিমাণ আদেশ দেয়ার ক্ষমতা তাদের আছে৷
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ওষুধে ভেজাল, মিশ্রণ বা নকল ওষুধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এই বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারেন৷ কিন্তু এর বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন না৷ ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলাও করতে পারেন না৷ বিচারের দায়িত্ব বিশেষ ট্রাইব্যুনালের৷
তারা সরাসরি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারে না৷ জেলা প্রশাসনের সহায়তায় নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা হয়৷
এর বাইরে এই অধিদপ্তর সভা-সেমিনারের মাধ্যমে সচেতনতামূলক কাজ করে৷ তাদের সব কাজের মূল লক্ষ্য হলো ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ৷
অভিযোগ ও নিষ্পত্তি
ভোক্তাদের অভিযোগ বাড়ছে৷ ২০২৩ সালে ২৬ হাজার ৬০৫টি অভিযোগ জমা পড়ে, যা তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০ হাজার বেশি৷ ২০২২ সালে অভিযোগের সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৫৪টি৷
২০১০ সালের ৬ এপ্রিল থেকে বাজার পর্যবেক্ষণ এবং অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি শুরু করে অধিদপ্তর৷ গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক লাখ ২৩ হাজার ৭৫৩টি অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা, যার সিংহভাগই ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের বিরুদ্ধে৷ এর মধ্যে এক লাখ ২১ হাজার ৩৬০টি অভিযোগ নিষ্পন্ন হয়েছে৷
সংস্থাটি অভিযোগ ছাড়াও নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন বাজারে এ পর্যন্ত ৭২ হাজার ৯৩৭টি অভিযানে এক লাখ ৭০ হাজার ৯০৮টি প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় এনেছে৷ তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করেছে ১২০ কোটি ২৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকার বেশি৷ এ ছাড়া ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ৯ হাজার ১৫০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বেশি জরিমানা করেছে৷ এর মধ্যে ২৫ শতাংশ হিসাবে অভিযোগকারীদের দেওয়া হয়েছে এক কোটি ৫৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকার বেশি৷ বাকি ৭৫ শতাংশ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়েছে৷
২০২১ সালের পর থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ই-কমার্সের বিরুদ্ধে ৩৪ হাজার ৮৪২টি অভিযোগ করা হয়৷ এর মধ্যে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ছয় হাজার ৩৮৮টি৷ মোট অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫ হাজার ৪৩৮টি বা ৪৪ দশমিক ৩১ শতাংশ৷ অধিদপ্তরের হটলাইনেও বেড়েছে অভিযোগ৷ সংস্থাটির কল সেন্টার ১৬১২১-এ গত সাত মাসে ৩৫ হাজারের বেশি কল করে অভিযোগ করেছেন ভোক্তারা৷
জনবল ও আইনের সমস্যা
ভোক্তা অধিদপ্তরে ৮২ জন কর্মকর্তাসহ মোট জনবল ২৮০ জন৷ দেশের ১৭টি জেলায় ভোক্তা অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা নেই৷ আর উপজেলা পর্যায়ে এখনো তাদের কাজ সম্প্রসারিত হয়নি৷ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘‘কাজের তুলনায় জনবল আছে এখন ১০ ভাগের এক ভাগ৷ আর আমাদের কাজ উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন৷” ২০০৯ সালের অর্গানোগ্রামে মোট অনুমাদিত জনবল ছিল ৩৬৬ জন৷ আরো ৪৫৭টি পদ সৃষ্টির আবেদন করা হলেও অনুমোদন মিলছে মাত্র ১২টির৷ এছাড়া আইন ও লজিস্টিক সাপোর্টে সমস্যা আছে৷ কর্মকর্তারা ভাড়া করা গাড়িতে অভিযানে যান৷ আর মেবাইল কোর্ট পরিচালনার সরাসরি এখতিয়ার নেই৷
তবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাস টিটু বলেন, ‘‘উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও এবং জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকেরা আছেন৷ তারাই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারেন৷ ফলে আমি মনে করি ভোক্তা অধিদপ্তরের জনবল বাড়ানো নয়, দরকার এটা নিয়ে প্রচার ও সচেতনতা৷ তারা পলিসি তৈরি করবেন৷ প্রশাসনের মাধ্যমে কার্যকর করা হবে৷” তার কথা, ‘‘জনপ্রতিনিধি ও ক্যাবের মতো যেসব সংগঠন আছে তাদের বেশি করে সম্পৃক্ত করতে হবে৷ সবখানে পুলিশিং নয়, দরকার সচেতনতা ও অংশগ্রহণ৷”