ভারত থেকে আমদানি-রপ্তানির হিসাবনামা
- আপডেট সময় : ০৫:২৭:৪৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ২৭ বার পঠিত
ঢাকা : সোশাল মিডিয়ায় ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রচার ছুঁয়েছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকেও। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীও কথা বলেছেন। ভারতের বিরোধী মনোভাব আর মুক্তবাজার অর্থনীতিকে গুলিয়ে ফেলছেন অনেকে। এই ইস্যু সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়িয়ে জাতীয় রাজনীতিতেও উঠে আসছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, গত এক দশকে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি তিন গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট আমদানির ১৮ শতাংশের বেশি আসে ভারত থেকে।
ভারত হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানি উৎস। এক্ষেত্রে শীর্ষে আছে চীন। সেখান থেকে বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশ আসে।
এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্বাভাবিক একটি বিষয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশেরও তা রয়েছে। তবে দুই দেশের বাণিজ্য ভারসাম্য হেলে আছে ভারতের দিকে। ভারত থেকে যত মূল্যের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ, রপ্তানি করে তার সাত ভাগের এক অংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি বিল পরিশোধের পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে দেখা যাবে, ২০১১-১২ অর্থবছরে ভারত থেকে ৪৭৪ কোটি (৪.৭৪ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ।
এর পরের ১০ বছরে আমদানি বেড়েই চলেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৬৯ কোটি (১৩.৬৯ বিলিয়ন) ডলারে।
তবে গত বছর ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কৃচ্ছ সাধনসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল, যার প্রভাব ভারতের আমদানিতেও পড়েছে।
সে কারণে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের সার্বিক আমদানি ১৬ শতাংশের মতো কমেছিল। ভারত থেকেও আমদানি কমে ১ হাজার ৬৩ কোটি (১০.৬৩ বিলিয়ন) ডলার হয় ২০২২-২৩ অর্থবছরে।
বাংলাদেশের আমদানি করা ভারতীয় পণ্যের তালিকায় শীর্ষে আছে তুলা। মোট আমদানি খরচের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হয় বস্ত্র খাতের এই কাঁচামাল আমদানিতে। এরপর আছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য। এছাড়া রয়েছে রেলের বগি, ইঞ্জিনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ।
ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে বড় পরিবর্তন এসেছে। শুরুর দিকে বাংলাদেশ ভারত থেকে মূলত পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ থেকে শুরু করে খাদ্যপণ্যই আমদানি করত। বর্তমান প্রবণতা হলো কাঁচামাল ও শিল্পায়নে প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রের মতো পণ্য আমদানি করা।
এর অর্থ হলো ভারত থেকে বাংলাদেশ যা আমদানি করছে, তার বড় অংশ রপ্তানি খাতে কাঁচামাল হিসেবে কিংবা যন্ত্রপাতি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য দেশের রপ্তানির কাঁচামাল জোগাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলত ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে ভারত থেকে আমদানি বেশি।
ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি, এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, “যেসব পণ্য ভারত থেকে আমদানি করা হয়, সেগুলো অন্য দেশ থেকে আনতে গেলে খরচ ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে।
“অন্য দেশের তুলনায় কম সময়ে ভারত থেকে পণ্য আমদানি করা যায়। সড়ক পথে আনা যায় বলে পরিবহন খরচও কম হয়। এই কারণে পেঁয়াজ, মরিচ বা চালের মতো পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল অন্য দেশে পাওয়া গেলেও আমদানিকারকদের প্রথম পছন্দ ভারত।”
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক। এই খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “আমরা আমাদের পোশাক খাতের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সিংহভাগ আমদানি করি ভারত থেকে।”
ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারতের পণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডস, চীন, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি।
ভারত থেকে আমদানির বিপরীতে রপ্তানির পরিমাণ অনেক কম হলেও গত কয়েক বছর ধরে তা বাড়ছে বলে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশি পণ্য ও সেবার রপ্তানি গন্তব্যের তালিকায় ভারতের স্থান ছিল দ্বাদশ। ওই বছর ভারতে ৮৭ কোটি ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানি হয়েছিল। পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতের অবস্থান এখন সপ্তম। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য ভারতে রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে ২১৩ কোটি (২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানি থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হয়নি।
এরই মধ্যে ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতেই, ১১ জুলাই থেকে শুরু হয় এই লেনদেন। সবাই আশা করেছিলেন, ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হলে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশটিতে রপ্তানি আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু তা না বেড়ে উল্টো কমছে।
ইপিবির সবশেষ তথ্যে দেখা, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ভারতের বাজারে ১২৭ কোটি ৩৯ লাখ (১.২৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।
এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে ১৫২ কোটি ৭৪ লাখ (১.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় এসেছিল।
বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় এ ধরনের প্রচার দেখা গেছে। গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এবারের প্রচার শুরু।
গত কিছুদিন ধরে সুনির্দিষ্টভাবে ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে ফেইসবুকে প্রচার চলছে কিছু গ্রুপ ও একাউন্ট থেকে। গ্রুপগুলোতে অনেকে যুক্ত হয়েছেন। কোনও কোনও গ্রুপে লক্ষাধিক সদস্যও দেখা গেছে। সোশাল মিডিয়ায় কন্টেন্টগুলোতে ‘ইন্ডিয়া আউট’ ও ‘বয়কটইন্ডিয়ানপ্রোডাক্টস’ হ্যাশট্যাগের ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে।
গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টির মতো কয়েকটি দলের নেতা-কর্মীরা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে ভারতবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছিলেন। এরপর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সংগতি প্রকাশে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা বেগ পায়।
ভারতের পণ্য বর্জনকে সমর্থন জানিয়ে রিজভী বলেন, “একটি আওয়াজ বা স্লোগান আজ সব মহলে সমাদৃত, সেটি হলো ভারতের পণ্য বর্জন। এ দেশের মানুষ দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অপমান, লাঞ্ছনা, ক্ষোভ থেকে এটি করছেন। কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে। কিন্তু সব মহলে, সব জনগণের মধ্যে এটি আজ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।”
ভারতের পণ্য বয়কটের এই আহ্বানকে স্থানীয় বাজারকে অস্থিতিশীল করার প্রয়াস হিসাবে দেখছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদও বলেন, ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজারকে অস্থিতিশীল করে পণ্যের দাম বাড়ানো।
নেতাদের বাগযুদ্ধের মধ্যে বুধবার এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভারতের পণ্য বয়কটের প্রসঙ্গটি আনেন। তিনি বলেন, “আমার প্রশ্ন, যে বিএনপি নেতারা বলছেন ভারতীয় পণ্য বর্জন, তাদের বউদের কয়খানা ভারতীয় শাড়ি আছে? তাদের বউদের কাছ থেকে সেই শাড়িগুলো এনে কেন পুড়িয়ে দিচ্ছেন না।”
এদিকে ভারতীয় পণ্য বর্জন নিয়ে ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কোনও দেশের পণ্য বর্জনের আলোচনা আসাটাই গ্রহণযোগ্য নয়। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “আমরা এ বিষয়টি নিয়ে মোটেই ভাবছি না। কে কী বললো, কে কোন আহ্বান বা ক্যাম্পেইন করল, সেটা দেখার সময় আমাদের নেই। যেখান থেকে সহজেই আমরা কাঁচামাল পাব, সেখান থেকেই আনব।”
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদও বলেন, ভারতীয় পণ্য বর্জনের ক্যাম্পেইনের কোনও প্রভাব তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, আজকের এই যুগে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনও সমস্যা দেখা দিলে পণ্য বর্জন করে নয়, আলোচনাই সমাধানের উপায়।