ঢাকা ০৬:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

বিপিডিবি: গত অর্থবছরে লোকসান ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় : ১১:৫৫:৪২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ৯৩ বার পঠিত

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় এবং বিক্রয় থেকে আহরিত রাজস্বের মধ্যে ব্যবধান বিস্তর। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিডিবি’র লোকসান হয়েছে ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এই সমস্যা সমাধানে সঠিক বিকল্প বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন নীতি নির্ধারকরা।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বিদ্যুতের দাম আরো বাড়ানো উচিত, নাকি ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে আরো বন্ড ইস্যু করা উচিত, তা নিয়ে শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা বিভক্ত।”

এই কর্মকর্তা আরো জানান, সরকার যদি বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায়, তাহলে রমজানের আগে বাড়াতে হবে; তা না হলে রমজানের পর দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিষয়টি প্রায় প্রতিদিনই নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচিত হচ্ছে।

বিপিডিবি’র লোকসানের ক্রমবর্ধমান বোঝা কমাতে তারা আরো বন্ড ইস্যু করার প্রভাব বিশ্লেষণ করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ১২ টাকা; বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৬ দশমিক ৭০ টাকা দরে।

বিপিডিবির আরেক জন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “এর মানে হলো, সরকারকে প্রতি ইউনিটে ৫ দশমিক ৩ টাকার অতিরিক্ত বোঝা বহন করতে হচ্ছে।”

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিপিডিবি ঐ অর্থবছরে মোট ৯৮ হাজার ৬৪৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয় করে, ৮৭ হাজার ২৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে।

প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ হয়েছে ১১ দশমিক ৩৩ টাকা। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি হয়েছে ৬ দশমিক ৭০ টাকা করে; এতে, লোকসান হয়েছে ইউনিট প্রতি ৪ দশমিক ৬৩ টাকা।

সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারিতে পাইকারি শুল্ক ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি ইউনিটের দাম ৬ দশমিক ২০ টাকা থেকে থেকে ৬ দশমিক ৭০ টাকা করা হয়। এই দাম কার্যকর হয় একই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে।

এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব আয় হয়েছে ৫০ হাজার ৮৫৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। লোকসান হয়েছে ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

এই বিশাল লোকসানে সরকার বিপাকে পড়েছে। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে ৮২ হাজার ৭৭৮ কোটি ২৫ লাখ টাকার বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে সরকারকে। আর, একই সময়ে, নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে ১৩ হাজার ৩০৬ কোটি ৬২ লাখ টাকার বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।

বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রে গড়ে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ ৭ দশমিক ৬৩ টাকা। স্বতন্ত্র উৎপাদন প্রতিষ্ঠান (আইপিপি) থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় প্রতি ইউনিট ১৪ দশমিক ৬২ টাকা দরে। আর, রেন্টাল কেন্দ্র থেকে বিদুৎ নিতে হয় ১২ দশমিক ৫৩ টাকায়। পাবলিক প্লান্টে খরচ হয় প্রতি ইউনিট ৬ দশমিক ৮৫ টাকা এবং ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের খরচ প্রতি ইউনিট ৮ দশমিক ৭৭ টাকা।

সরকার বেসরকারি খাত ও ভারত থেকে ডলারে বিদ্যুৎ কেনে। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, সরকারের জমা হওয়া বকেয়া বিল এখন প্রায় ৫০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে, বিদ্যুৎ খাতে বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি ডলার (প্রায় ৪৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা) এবং বাকি ১০০ কোটি ডলার বকেয়া হয়েছে জ্বালানি খাতে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সংকটের এই ভয়াবহতার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “আসলে সংকটটা স্থানীয় মুদ্রার নয়। যেভাবেই হোক আমরা একটা ব্যবস্থা করতে পারবো। তবে মূল সংকট ডলার নিয়ে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছি না।”

নসরুল হামিদ আরো বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ঋণ পরিশোধের জন্য প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার প্রয়োজন।

এমন পরিস্থিতিতে বিপিডিব’র কিছু পাওনা পরিশোধের সুবিধার্থে সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি বন্ড চালু করেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমরা ৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছেড়েছি এবং এটি বেড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে।”

তিনি আরো বলেন, এজন্য সরকারকে বিদ্যুতের দাম আরো বাড়াতে হবে বা আরো বন্ড চালু করতে হবে। “যদি আরো বন্ড চালু করা হয়, তবে এটি ব্যাংকিং খাত থেকে বেসরকারি খাতের আমানতের ওপর চাপ বাড়াতে পারে; বলেন এই কর্মকর্তা

তবে নীতি নির্ধারকরা কী করবেন, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো ঝুলে রয়েছে; যোগ করেন বিপিডিবি’র কর্মকর্তা।

Facebook Comments Box
ট্যাগস :

বিপিডিবি: গত অর্থবছরে লোকসান ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা

আপডেট সময় : ১১:৫৫:৪২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় এবং বিক্রয় থেকে আহরিত রাজস্বের মধ্যে ব্যবধান বিস্তর। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিডিবি’র লোকসান হয়েছে ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এই সমস্যা সমাধানে সঠিক বিকল্প বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন নীতি নির্ধারকরা।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বিদ্যুতের দাম আরো বাড়ানো উচিত, নাকি ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে আরো বন্ড ইস্যু করা উচিত, তা নিয়ে শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা বিভক্ত।”

এই কর্মকর্তা আরো জানান, সরকার যদি বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায়, তাহলে রমজানের আগে বাড়াতে হবে; তা না হলে রমজানের পর দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিষয়টি প্রায় প্রতিদিনই নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচিত হচ্ছে।

বিপিডিবি’র লোকসানের ক্রমবর্ধমান বোঝা কমাতে তারা আরো বন্ড ইস্যু করার প্রভাব বিশ্লেষণ করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ১২ টাকা; বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৬ দশমিক ৭০ টাকা দরে।

বিপিডিবির আরেক জন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “এর মানে হলো, সরকারকে প্রতি ইউনিটে ৫ দশমিক ৩ টাকার অতিরিক্ত বোঝা বহন করতে হচ্ছে।”

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিপিডিবি ঐ অর্থবছরে মোট ৯৮ হাজার ৬৪৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয় করে, ৮৭ হাজার ২৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে।

প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ হয়েছে ১১ দশমিক ৩৩ টাকা। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি হয়েছে ৬ দশমিক ৭০ টাকা করে; এতে, লোকসান হয়েছে ইউনিট প্রতি ৪ দশমিক ৬৩ টাকা।

সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারিতে পাইকারি শুল্ক ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি ইউনিটের দাম ৬ দশমিক ২০ টাকা থেকে থেকে ৬ দশমিক ৭০ টাকা করা হয়। এই দাম কার্যকর হয় একই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে।

এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব আয় হয়েছে ৫০ হাজার ৮৫৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। লোকসান হয়েছে ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

এই বিশাল লোকসানে সরকার বিপাকে পড়েছে। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে ৮২ হাজার ৭৭৮ কোটি ২৫ লাখ টাকার বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে সরকারকে। আর, একই সময়ে, নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে ১৩ হাজার ৩০৬ কোটি ৬২ লাখ টাকার বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।

বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রে গড়ে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ ৭ দশমিক ৬৩ টাকা। স্বতন্ত্র উৎপাদন প্রতিষ্ঠান (আইপিপি) থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় প্রতি ইউনিট ১৪ দশমিক ৬২ টাকা দরে। আর, রেন্টাল কেন্দ্র থেকে বিদুৎ নিতে হয় ১২ দশমিক ৫৩ টাকায়। পাবলিক প্লান্টে খরচ হয় প্রতি ইউনিট ৬ দশমিক ৮৫ টাকা এবং ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের খরচ প্রতি ইউনিট ৮ দশমিক ৭৭ টাকা।

সরকার বেসরকারি খাত ও ভারত থেকে ডলারে বিদ্যুৎ কেনে। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, সরকারের জমা হওয়া বকেয়া বিল এখন প্রায় ৫০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে, বিদ্যুৎ খাতে বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি ডলার (প্রায় ৪৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা) এবং বাকি ১০০ কোটি ডলার বকেয়া হয়েছে জ্বালানি খাতে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সংকটের এই ভয়াবহতার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “আসলে সংকটটা স্থানীয় মুদ্রার নয়। যেভাবেই হোক আমরা একটা ব্যবস্থা করতে পারবো। তবে মূল সংকট ডলার নিয়ে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছি না।”

নসরুল হামিদ আরো বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ঋণ পরিশোধের জন্য প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার প্রয়োজন।

এমন পরিস্থিতিতে বিপিডিব’র কিছু পাওনা পরিশোধের সুবিধার্থে সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি বন্ড চালু করেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমরা ৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছেড়েছি এবং এটি বেড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে।”

তিনি আরো বলেন, এজন্য সরকারকে বিদ্যুতের দাম আরো বাড়াতে হবে বা আরো বন্ড চালু করতে হবে। “যদি আরো বন্ড চালু করা হয়, তবে এটি ব্যাংকিং খাত থেকে বেসরকারি খাতের আমানতের ওপর চাপ বাড়াতে পারে; বলেন এই কর্মকর্তা

তবে নীতি নির্ধারকরা কী করবেন, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো ঝুলে রয়েছে; যোগ করেন বিপিডিবি’র কর্মকর্তা।

Facebook Comments Box