বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড : চলছে নামে-বেনামে ‘অবাধে’
- আপডেট সময় : ০৬:০১:৫১ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০২৪ ৪ বার পঠিত
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময় বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যাপক সমালোচিত৷ অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসেও কি বিচার বহির্ভূত হত্যা আর মানবাধিকার পরিস্থিতিতে কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে?
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে গণপিটুনি বা তথাকথিত মব জাস্টিসের শিকার হয়ে নিহত হয়েছিলেন ৫১ জন৷ চলতি বছরের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর- এই তিন মাসেই নিহত হয়েছেন ৬৮ জন৷ ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়৷ আসক-এর তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ২০ জন৷ আর চলতি বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস আগস্ট থেকে অক্টোবরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ওভাবে নিহত হয়েছেন সাত জন৷ চলতি নভেম্বরেও একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷
মানবাধিকার কর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, ‘‘এখন আমরা দেখছি মব জাস্টিসের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যা ভয়াবহভাবে ফিরে এসেছে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে৷’’
আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘‘পতিত শেখ হাসিনা সরকারের গত বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর- এই তিন মাসের তুলনায় বর্তমান সরকারের তিন মাসে বিচার বহির্ভৃত হত্যা ও মব জাস্টিসের নামে হত্যা বেড়েছে৷’’
এই সময়ে যারা কথিত গণপিটুনি বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কথা বলতে চাইছেন না৷
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলা হাটে দুই ভাই ইয়াকুব ও আলমগীরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বুধবার রাতে৷ তাদের চাচা আব্দুল হালিমকে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘‘পিটিয়ে হত্যার পর আমরা খবর পেয়ে হাসপাতালে যাই৷ কিন্তু কেন হত্যা করা হয়েছে, কারা হত্যা করেছে তার কিছুই আমরা জানি না৷”
পুলিশ জানায়, তাদের ‘ছিনতাইকারী’ বলে উত্তেজিত জনতা পিটিয়ে হত্যা করেছে৷
খুলনায় আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের বোনের ছেলে শেখ আরিফুজ্জামান রূপম (৩৪) তথাকথিত গণপিটুনিতে নিহত হন সোমবার সকালে৷ তার মত্যু নিয়ে কথা বলতে চাননি তার চাচা এস এম মাহমুদ৷ মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন তার দাফন নিয়ে ব্যস্ত, কথা বলা সম্ভব নয়৷ কারা মেরেছে, কেন মেরেছে বলতে পারছি না৷ আর পুলিশের কাছে যেয়ে কী হবে?”
৩০ অক্টোবর নড়াইলে মাইকিং করে গরু চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ ১ নভেম্বর ভোর রাতে সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার খলিশাখালি এলাকায় যৌথ বাহিনীর অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের সময় তথাকথিত গণপিটুনিতে কামরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি নিহত হন৷ মামলা হলেও কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি৷
এর আগের কিছু তথাকথিত মব জাস্টিসের শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ সারা দেশে আলোড়ন তুলেছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে ‘চোর’ সন্দেহের কথা বলে রীতিমতো পরিকল্পনা করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ হত্যার সময় তোফায়েলের খিদে পেলে তাকে ভাত খেতে দেয়া হয়৷ ভাত খাওয়ার পর আবার তাকে পিটানো হয়৷ হাসপাতালে নিলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন৷
একই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে৷ এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা৷
চট্টগ্রামে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নেচে-গেয়ে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ হত্যার এক মাস পর ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে৷
১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় চোর সন্দেহে মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ তার জেরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে চার জন আদিবাসী নিহত হন৷ ঘর-বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ কয়েকদিন পর আবারো পাহাড়ে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগে আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোহেল রানা নামের ওই শিক্ষকে পিটিয়ে হত্যার পর পাহাড়ি বঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়৷
নূর খান বলেন, ‘‘একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে একজন হত্যার ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার ছাড়া এই ধরনের ঘটনায় আর কোনো গ্রেপ্তারের খবর আমার জানা নাই৷’’
গুম কমিশন মঙ্গলবার জানিয়েছে, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তাদের কাছে এক হাজার ৬০০-র মতো গুমের অভিযোগ জমা পড়েছে৷ এগুলো গত সরকারের আমলের ঘটনা৷ এর মধ্যে ৪০০ অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে৷ পর্যায়ক্রমে বাকিগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ ৪০০ অভিযোগের মধ্যে ১৭২টি অভিযোগের সঙ্গে র্যাবের সংশ্লিষ্টতা আছে৷ কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ৩৭টি অভিযোগের সঙ্গে৷ ডিবির (গোয়েন্দা পুলিশ) সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ৫৫টির সঙ্গে৷ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ২৬টির সঙ্গে৷ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ২৫টি অভিযোগের সঙ্গে৷
অন্যদিকে ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ২০ বছরে অন্তত দুই হাজার ৯৫৪টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত তথ্য পেয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র৷
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারের কোনো প্রক্রিয়া দেখছি না৷ আগের সরকারের আমলে হয়েছে, এখন আবার হচ্ছে৷ এটা তো জট পাকিয়ে যাচ্ছে৷ আগের বিচারই হচ্ছে না৷ এখনকার বিচার কে, কখন করবে?”
এলিনা খান মনে করেন, ‘‘বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে এই ধরনের অপরাধের বিচার হতো আর মানবাধিকার লঙ্ঘন কমে যেতো৷ কিন্তু আগে যেমন বিচার বিভাগ স্বাধীন ছিল না, কাজ করতে পারতো না, এখনো পরিস্থিতি বদলায়নি৷ আগে ছিলো রাজনৈতিক প্রভাবের বিচারব্যবস্থা আর এখন বিচার ব্যবস্থার কাঠামোই নাই৷’’
‘‘আমরা বলেছিলাম বিচার বহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত র্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিচারের আওয়তায় আনতে৷ তা-ও করা হচ্ছে না,’’ বলেন তিনি৷
মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন, ‘‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে আমরা একটা নতুন আলামত দেখছি৷ আগে করতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, এখন সেটা মব জাস্টিসের নামে করা হচ্ছে৷ গণপিটুনির নামে হচ্ছে৷ এটা আরো ভয়াবহ আকারে এসেছে৷ আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও নিহত হচ্ছে৷’’
তার কথা, ‘‘আসলে এইসব বন্ধ এবং বিচারের জন্য সরকারের কমিটমেন্ট খুব জরুরি৷ কিন্তু সেটা দৃশ্যমান হচ্ছে না৷ বিচারের আওতায় আনা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া খুব জরুরি৷’’
বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘‘এই অল্প সময় (তিন মাসের) তুলনা করলে আগের সরকারের চেয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও মব জাস্টিস বেড়েছে৷ এটা হয়েছে সরকারের কমিটমেন্টের অভাবে৷ সরকার মুখে বলছে৷ কিন্তু কাজে করছে না৷ এর মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার রক্ষা সুদুর পরাহত৷’’
আর বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘‘মব জাস্টিসের নামে যা চলছে তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে৷ মানবাধিকার, মানুষের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার এগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হলে ওইসব অপরাধ বন্ধ করতে হবে৷ অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে৷ আমরা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সময়ে যা দেখেছি এখনো তা দেখতে চাই না৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আসলে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট না থাকলে এই সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ হবে না৷ এজন্যই তো আমরা দ্রুত নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছি৷’’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনা সম্পর্কে চেষ্টা করেও পুলিশ সদর দপ্তরের বক্তব্য জানা যায়নি৷ তবে সম্প্রতি এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, ‘‘পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠকে মব জাস্টিস বন্ধ করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে৷ দেশের থানাসহ সব পুলিশ ইউনিটকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ আর এই ধরনের ঘটনা কোথাও ঘটলে পুলিশকে দ্রুত খবর দিতে জনসাধারণকে বার বার অনুরোধ করা হচ্ছে৷ পুলিশ সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে রেসপন্স করবে৷ আর পুলিশ যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটায় তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷’’ ডয়চে ভেলে