ঢাকা ১২:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo ট্রাইব্যুনালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক কর্তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হলো Logo ভাঙ্গুড়া প্রেস ক্লাবের অবৈধ কমিটি বাতিলের দাবিতে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান Logo মৌলভীবাজার পূজা উদযাপন পরিষদের সম্পাদক মহিম গ্রেপ্তার Logo পাবনার আমিনপুরে ইজিবাইক-মোটর সাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষ, শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ Logo সেনাকুঞ্জে যাবেন খালেদা জিয়া Logo সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ সিওয়াইবির কমিটি গঠন Logo সৈয়দপুর বাসটার্মিনালে বেহাল অবস্থা, যাত্রীসাধারনের দুর্ভোগ Logo ‘ফ্যাসিবাদী বয়ান’ দেওয়া গণমাধ্যম চিহ্নিত করা হবে: প্রেস সচিব Logo রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সড়ক অবরোধ Logo তিন দিনের মধ্যে ঢাকা মহানগরে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ

বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড : চলছে নামে-বেনামে ‘অবাধে’

সারাবেলা প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় : ০৬:০১:৫১ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০২৪ ৪ বার পঠিত

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময় বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যাপক সমালোচিত৷ অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসেও কি বিচার বহির্ভূত হত্যা আর মানবাধিকার পরিস্থিতিতে কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে?

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে গণপিটুনি বা তথাকথিত মব জাস্টিসের শিকার হয়ে নিহত হয়েছিলেন ৫১ জন৷ চলতি বছরের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর- এই তিন মাসেই নিহত হয়েছেন ৬৮ জন৷ ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়৷ আসক-এর তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ২০ জন৷ আর চলতি বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস আগস্ট থেকে অক্টোবরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ওভাবে নিহত হয়েছেন সাত জন৷ চলতি নভেম্বরেও একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷
মানবাধিকার কর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, ‘‘এখন আমরা দেখছি মব জাস্টিসের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যা ভয়াবহভাবে ফিরে এসেছে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে৷’’
আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘‘পতিত শেখ হাসিনা সরকারের গত বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর- এই তিন মাসের তুলনায় বর্তমান সরকারের তিন মাসে বিচার বহির্ভৃত হত্যা ও মব জাস্টিসের নামে হত্যা বেড়েছে৷’’
এই সময়ে যারা কথিত গণপিটুনি বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কথা বলতে চাইছেন না৷
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলা হাটে দুই ভাই ইয়াকুব ও আলমগীরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বুধবার রাতে৷ তাদের চাচা আব্দুল হালিমকে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘‘পিটিয়ে হত্যার পর আমরা খবর পেয়ে হাসপাতালে যাই৷ কিন্তু কেন হত্যা করা হয়েছে, কারা হত্যা করেছে তার কিছুই আমরা জানি না৷”
পুলিশ জানায়, তাদের ‘ছিনতাইকারী’ বলে উত্তেজিত জনতা পিটিয়ে হত্যা করেছে৷
খুলনায় আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের বোনের ছেলে শেখ আরিফুজ্জামান রূপম (৩৪) তথাকথিত গণপিটুনিতে নিহত হন সোমবার সকালে৷ তার মত্যু নিয়ে কথা বলতে চাননি তার চাচা এস এম মাহমুদ৷ মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন তার দাফন নিয়ে ব্যস্ত, কথা বলা সম্ভব নয়৷ কারা মেরেছে, কেন মেরেছে বলতে পারছি না৷ আর পুলিশের কাছে যেয়ে কী হবে?”


৩০ অক্টোবর নড়াইলে মাইকিং করে গরু চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ ১ নভেম্বর ভোর রাতে সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার খলিশাখালি এলাকায় যৌথ বাহিনীর অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের সময় তথাকথিত গণপিটুনিতে কামরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি নিহত হন৷ মামলা হলেও কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি৷
এর আগের কিছু তথাকথিত মব জাস্টিসের শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ সারা দেশে আলোড়ন তুলেছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে ‘চোর’ সন্দেহের কথা বলে রীতিমতো পরিকল্পনা করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ হত্যার সময় তোফায়েলের খিদে পেলে তাকে ভাত খেতে দেয়া হয়৷ ভাত খাওয়ার পর আবার তাকে পিটানো হয়৷ হাসপাতালে নিলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন৷
একই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে৷ এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা৷
চট্টগ্রামে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নেচে-গেয়ে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ হত্যার এক মাস পর ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে৷
১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় চোর সন্দেহে মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ তার জেরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে চার জন আদিবাসী নিহত হন৷ ঘর-বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ কয়েকদিন পর আবারো পাহাড়ে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগে আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোহেল রানা নামের ওই শিক্ষকে পিটিয়ে হত্যার পর পাহাড়ি বঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়৷
নূর খান বলেন, ‘‘একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে একজন হত্যার ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার ছাড়া এই ধরনের ঘটনায় আর কোনো গ্রেপ্তারের খবর আমার জানা নাই৷’’
গুম কমিশন মঙ্গলবার জানিয়েছে, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তাদের কাছে এক হাজার ৬০০-র মতো গুমের অভিযোগ জমা পড়েছে৷ এগুলো গত সরকারের আমলের ঘটনা৷ এর মধ্যে ৪০০ অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে৷ পর্যায়ক্রমে বাকিগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ ৪০০ অভিযোগের মধ্যে ১৭২টি অভিযোগের সঙ্গে র্যাবের সংশ্লিষ্টতা আছে৷ কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ৩৭টি অভিযোগের সঙ্গে৷ ডিবির (গোয়েন্দা পুলিশ) সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ৫৫টির সঙ্গে৷ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ২৬টির সঙ্গে৷ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ২৫টি অভিযোগের সঙ্গে৷
অন্যদিকে ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ২০ বছরে অন্তত দুই হাজার ৯৫৪টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত তথ্য পেয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র৷
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারের কোনো প্রক্রিয়া দেখছি না৷ আগের সরকারের আমলে হয়েছে, এখন আবার হচ্ছে৷ এটা তো জট পাকিয়ে যাচ্ছে৷ আগের বিচারই হচ্ছে না৷ এখনকার বিচার কে, কখন করবে?”
এলিনা খান মনে করেন, ‘‘বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে এই ধরনের অপরাধের বিচার হতো আর মানবাধিকার লঙ্ঘন কমে যেতো৷ কিন্তু আগে যেমন বিচার বিভাগ স্বাধীন ছিল না, কাজ করতে পারতো না, এখনো পরিস্থিতি বদলায়নি৷ আগে ছিলো রাজনৈতিক প্রভাবের বিচারব্যবস্থা আর এখন বিচার ব্যবস্থার কাঠামোই নাই৷’’
‘‘আমরা বলেছিলাম বিচার বহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত র্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিচারের আওয়তায় আনতে৷ তা-ও করা হচ্ছে না,’’ বলেন তিনি৷
মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন, ‘‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে আমরা একটা নতুন আলামত দেখছি৷ আগে করতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, এখন সেটা মব জাস্টিসের নামে করা হচ্ছে৷ গণপিটুনির নামে হচ্ছে৷ এটা আরো ভয়াবহ আকারে এসেছে৷ আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও নিহত হচ্ছে৷’’
তার কথা, ‘‘আসলে এইসব বন্ধ এবং বিচারের জন্য সরকারের কমিটমেন্ট খুব জরুরি৷ কিন্তু সেটা দৃশ্যমান হচ্ছে না৷ বিচারের আওতায় আনা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া খুব জরুরি৷’’
বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘‘এই অল্প সময় (তিন মাসের) তুলনা করলে আগের সরকারের চেয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও মব জাস্টিস বেড়েছে৷ এটা হয়েছে সরকারের কমিটমেন্টের অভাবে৷ সরকার মুখে বলছে৷ কিন্তু কাজে করছে না৷ এর মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার রক্ষা সুদুর পরাহত৷’’
আর বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘‘মব জাস্টিসের নামে যা চলছে তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে৷ মানবাধিকার, মানুষের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার এগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হলে ওইসব অপরাধ বন্ধ করতে হবে৷ অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে৷ আমরা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সময়ে যা দেখেছি এখনো তা দেখতে চাই না৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আসলে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট না থাকলে এই সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ হবে না৷ এজন্যই তো আমরা দ্রুত নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছি৷’’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনা সম্পর্কে চেষ্টা করেও পুলিশ সদর দপ্তরের বক্তব্য জানা যায়নি৷ তবে সম্প্রতি এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, ‘‘পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠকে মব জাস্টিস বন্ধ করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে৷ দেশের থানাসহ সব পুলিশ ইউনিটকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ আর এই ধরনের ঘটনা কোথাও ঘটলে পুলিশকে দ্রুত খবর দিতে জনসাধারণকে বার বার অনুরোধ করা হচ্ছে৷ পুলিশ সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে রেসপন্স করবে৷ আর পুলিশ যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটায় তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷’’ ডয়চে ভেলে

Facebook Comments Box
ট্যাগস :

বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড : চলছে নামে-বেনামে ‘অবাধে’

আপডেট সময় : ০৬:০১:৫১ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০২৪

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময় বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যাপক সমালোচিত৷ অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসেও কি বিচার বহির্ভূত হত্যা আর মানবাধিকার পরিস্থিতিতে কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে?

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে গণপিটুনি বা তথাকথিত মব জাস্টিসের শিকার হয়ে নিহত হয়েছিলেন ৫১ জন৷ চলতি বছরের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর- এই তিন মাসেই নিহত হয়েছেন ৬৮ জন৷ ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়৷ আসক-এর তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ২০ জন৷ আর চলতি বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস আগস্ট থেকে অক্টোবরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ওভাবে নিহত হয়েছেন সাত জন৷ চলতি নভেম্বরেও একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷
মানবাধিকার কর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, ‘‘এখন আমরা দেখছি মব জাস্টিসের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যা ভয়াবহভাবে ফিরে এসেছে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে৷’’
আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘‘পতিত শেখ হাসিনা সরকারের গত বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর- এই তিন মাসের তুলনায় বর্তমান সরকারের তিন মাসে বিচার বহির্ভৃত হত্যা ও মব জাস্টিসের নামে হত্যা বেড়েছে৷’’
এই সময়ে যারা কথিত গণপিটুনি বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কথা বলতে চাইছেন না৷
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলা হাটে দুই ভাই ইয়াকুব ও আলমগীরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বুধবার রাতে৷ তাদের চাচা আব্দুল হালিমকে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘‘পিটিয়ে হত্যার পর আমরা খবর পেয়ে হাসপাতালে যাই৷ কিন্তু কেন হত্যা করা হয়েছে, কারা হত্যা করেছে তার কিছুই আমরা জানি না৷”
পুলিশ জানায়, তাদের ‘ছিনতাইকারী’ বলে উত্তেজিত জনতা পিটিয়ে হত্যা করেছে৷
খুলনায় আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের বোনের ছেলে শেখ আরিফুজ্জামান রূপম (৩৪) তথাকথিত গণপিটুনিতে নিহত হন সোমবার সকালে৷ তার মত্যু নিয়ে কথা বলতে চাননি তার চাচা এস এম মাহমুদ৷ মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন তার দাফন নিয়ে ব্যস্ত, কথা বলা সম্ভব নয়৷ কারা মেরেছে, কেন মেরেছে বলতে পারছি না৷ আর পুলিশের কাছে যেয়ে কী হবে?”


৩০ অক্টোবর নড়াইলে মাইকিং করে গরু চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ ১ নভেম্বর ভোর রাতে সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার খলিশাখালি এলাকায় যৌথ বাহিনীর অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের সময় তথাকথিত গণপিটুনিতে কামরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি নিহত হন৷ মামলা হলেও কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি৷
এর আগের কিছু তথাকথিত মব জাস্টিসের শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ সারা দেশে আলোড়ন তুলেছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে ‘চোর’ সন্দেহের কথা বলে রীতিমতো পরিকল্পনা করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ হত্যার সময় তোফায়েলের খিদে পেলে তাকে ভাত খেতে দেয়া হয়৷ ভাত খাওয়ার পর আবার তাকে পিটানো হয়৷ হাসপাতালে নিলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন৷
একই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে৷ এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা৷
চট্টগ্রামে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নেচে-গেয়ে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ হত্যার এক মাস পর ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে৷
১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় চোর সন্দেহে মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ তার জেরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে চার জন আদিবাসী নিহত হন৷ ঘর-বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ কয়েকদিন পর আবারো পাহাড়ে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগে আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোহেল রানা নামের ওই শিক্ষকে পিটিয়ে হত্যার পর পাহাড়ি বঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়৷
নূর খান বলেন, ‘‘একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে একজন হত্যার ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার ছাড়া এই ধরনের ঘটনায় আর কোনো গ্রেপ্তারের খবর আমার জানা নাই৷’’
গুম কমিশন মঙ্গলবার জানিয়েছে, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তাদের কাছে এক হাজার ৬০০-র মতো গুমের অভিযোগ জমা পড়েছে৷ এগুলো গত সরকারের আমলের ঘটনা৷ এর মধ্যে ৪০০ অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে৷ পর্যায়ক্রমে বাকিগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ ৪০০ অভিযোগের মধ্যে ১৭২টি অভিযোগের সঙ্গে র্যাবের সংশ্লিষ্টতা আছে৷ কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ৩৭টি অভিযোগের সঙ্গে৷ ডিবির (গোয়েন্দা পুলিশ) সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ৫৫টির সঙ্গে৷ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ২৬টির সঙ্গে৷ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ২৫টি অভিযোগের সঙ্গে৷
অন্যদিকে ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ২০ বছরে অন্তত দুই হাজার ৯৫৪টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত তথ্য পেয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র৷
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারের কোনো প্রক্রিয়া দেখছি না৷ আগের সরকারের আমলে হয়েছে, এখন আবার হচ্ছে৷ এটা তো জট পাকিয়ে যাচ্ছে৷ আগের বিচারই হচ্ছে না৷ এখনকার বিচার কে, কখন করবে?”
এলিনা খান মনে করেন, ‘‘বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে এই ধরনের অপরাধের বিচার হতো আর মানবাধিকার লঙ্ঘন কমে যেতো৷ কিন্তু আগে যেমন বিচার বিভাগ স্বাধীন ছিল না, কাজ করতে পারতো না, এখনো পরিস্থিতি বদলায়নি৷ আগে ছিলো রাজনৈতিক প্রভাবের বিচারব্যবস্থা আর এখন বিচার ব্যবস্থার কাঠামোই নাই৷’’
‘‘আমরা বলেছিলাম বিচার বহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত র্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিচারের আওয়তায় আনতে৷ তা-ও করা হচ্ছে না,’’ বলেন তিনি৷
মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন, ‘‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে আমরা একটা নতুন আলামত দেখছি৷ আগে করতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, এখন সেটা মব জাস্টিসের নামে করা হচ্ছে৷ গণপিটুনির নামে হচ্ছে৷ এটা আরো ভয়াবহ আকারে এসেছে৷ আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও নিহত হচ্ছে৷’’
তার কথা, ‘‘আসলে এইসব বন্ধ এবং বিচারের জন্য সরকারের কমিটমেন্ট খুব জরুরি৷ কিন্তু সেটা দৃশ্যমান হচ্ছে না৷ বিচারের আওতায় আনা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া খুব জরুরি৷’’
বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘‘এই অল্প সময় (তিন মাসের) তুলনা করলে আগের সরকারের চেয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও মব জাস্টিস বেড়েছে৷ এটা হয়েছে সরকারের কমিটমেন্টের অভাবে৷ সরকার মুখে বলছে৷ কিন্তু কাজে করছে না৷ এর মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার রক্ষা সুদুর পরাহত৷’’
আর বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘‘মব জাস্টিসের নামে যা চলছে তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে৷ মানবাধিকার, মানুষের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার এগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হলে ওইসব অপরাধ বন্ধ করতে হবে৷ অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে৷ আমরা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সময়ে যা দেখেছি এখনো তা দেখতে চাই না৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আসলে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট না থাকলে এই সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ হবে না৷ এজন্যই তো আমরা দ্রুত নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছি৷’’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনা সম্পর্কে চেষ্টা করেও পুলিশ সদর দপ্তরের বক্তব্য জানা যায়নি৷ তবে সম্প্রতি এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, ‘‘পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠকে মব জাস্টিস বন্ধ করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে৷ দেশের থানাসহ সব পুলিশ ইউনিটকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ আর এই ধরনের ঘটনা কোথাও ঘটলে পুলিশকে দ্রুত খবর দিতে জনসাধারণকে বার বার অনুরোধ করা হচ্ছে৷ পুলিশ সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে রেসপন্স করবে৷ আর পুলিশ যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটায় তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷’’ ডয়চে ভেলে

Facebook Comments Box