প্রিন্ট এর তারিখঃ অক্টোবর ১৯, ২০২৪, ৫:৩৩ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ জানুয়ারী ৩১, ২০২৪, ১০:৫১ পি.এম
বাংলাদেশের যে প্রকল্প চীনের পছন্দ : ভারতের আপত্তি
তিস্তা নদীতে বাংলাদেশ অংশে একটি বহুমুখী ব্যারেজ নির্মাণের জন্য চীন যে তৎপর হয়েছে, সেটি আটকে আছে ভারতের আপত্তির কারণে। শেখ হাসিনার সরকার টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত প্রকল্পটির ব্যাপারে আবারো আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, নির্বাচনের পর তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হবার বিষয়ে তিনি আশাবাদী।
নির্বাচনের পরে চীনের রাষ্ট্রদূত তার সেই আগ্রহ চাপা রাখেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সাথে এক বৈঠকের পর রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ চাইলে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার বিষয়ে তৈরি আছে চীন।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের দিক থেকে প্রকল্পের প্রস্তাব পেলে চীন সহযোগিতা দেবে।
কিন্তু তিস্তা নদীর উপর এ প্রকল্প নিয়ে ভারত এবং চীন পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে।
পর্যবেক্ষকদের অনেককেই ধারণা করেন, ভারতের আপত্তির কারণেই চীনের সাথে এ প্রকল্প নিয়ে এগুতে পারছে না বাংলাদেশ।
মোদ্দা কথা হচ্ছে – তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প ভূ-রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
[caption id="attachment_14588" align="aligncenter" width="300"] ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তিস্তা নদী[/caption]
তিস্তা নিয়ে চীনের আগ্রহ কেন?
পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, তিস্তা নিয়ে চীনের আগ্রহ মূলত কৌশলগত। এ প্রকল্পটিকে চীন ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে।
হিমালয়ে উৎপত্তির পর তিস্তা নদী ভারতের সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। দুই দেশের অর্থনীতির জন্যই এ নদী বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহী হয়ে ওঠার বড় কারণ হচ্ছে তাদের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই প্রজেক্ট।
বিআরআই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশকে একই সুতোয় গাঁথতে চাইছে। চীনের বিআরআই প্রকল্পের আওতাধীন বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর।
প্রস্তাবিত এই করিডোরের মাধ্যমে চীন তাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ইউনান প্রদেশকে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে যুক্ত করতে চায়। এজন্য তিস্তা বহুমুখী প্রকল্পকে চীন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে।
ভারতের গবেষণা সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক অনুসূয়া বসু রায়চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, চীন প্রথম যেভাবে 'বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' করতে চেয়েছিল সেখানে থেকে পরিস্থিতি এখন অনেক বদলেছে।
বিগত বছরগুলোতে ভারত ও চীনের সস্পর্ক নানা চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।
"অন্য কোনভাবে এই করিডোরগুলো বা এই ধরণের কানেক্টিভিটি প্ল্যানগুলো চরিতার্থ করা যায় কি না সেটা অবম্যই চীনের উদ্দেশ্য তো থাকবেই," বলছিলেন অনুসূয়া বসু রায়চৌধুরী।
তবে এ নিয়ে ভিন্নমতও আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ভারতের সিকিম হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত তিস্তার অববাহিকা ঘুরে দেখেছেন।
অধ্যাপক আহমেদ মনে করেন, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহ এখানে গৌণ এবং তাদের কোন ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত নেই।
অধ্যাপক আহমেদ বলেন, "তিস্তা নদীতে এটি বাংলাদেশের প্রকল্প, এটি চীনের কোন প্রকল্প নয়। চীন শুধু এখানে অর্থায়ন করতে রাজী হয়েছে। কারণ অন্যরা সে অর্থ দিতে পারছেনা।"
তিস্তা নদীর পানি বন্টণ নিয়ে ভারত যেহেতু বাংলাদেশের সাথে চুক্তি করতে পারছেনা, সেজন্য এর বিকল্প একটি সমাধান খুঁজছে বাংলাদেশ।
এজন্য তিস্তা প্রকল্প সামনে এনেছিল বাংলাদেশ, এ প্র্রকল্প চীনের ভাবনা থেকে আসেনি। এটা বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের চিন্তা থেকে এসেছিল - বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আহমেদ।
বাংলাদেশের অংশ তিস্তা নদীর অববাহিকায় উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষের কৃষি ও মৎস্যসহ নানা ধরণের কর্মকাণ্ড জড়িত।
তিস্তা প্রকল্পের সাথে চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সম্পর্কের বিষয়টি পরিষ্কার নয় অধ্যাপক আহমেদের কাছে।
তিনি বলেন, "কলকাতার সাথে সংযোগের বিষয়টি পদ্মা সেতুর মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে তিস্তা প্রকল্পের মাধ্যমে সংযোগ কীভাবে হবে," এমন প্রশ্ন তুলছেন অধ্যাপক আহমেদ।
তিনি মনে করেন, যারা প্রবলভাবে ভারত কিংবা চীন বিরোধী তারা এসব কথা বলছে।
[caption id="attachment_14589" align="aligncenter" width="300"] বর্ষাকালে বন্যার প্রকোপ ও শীতকালে শুকিয়ে যায় তিস্তা নদী[/caption]
তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহকে ভারত বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। ভারত মনে করে, চীন তাদের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে চায়।
ভারতের গবেষণা সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অনুসূয়া বসু রায়চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, তিস্তা প্রকল্পের যে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে সেটি অস্বীকার করা যাবেনা।
তিনি বলেন, ভূ-কৌশলগতভাবে গুরুত্ব বহন করে এমন সব প্রকল্প নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চীন 'অতিরিক্ত আগ্রহ' প্রকাশ করে। চীন চায় তাদের উপস্থিতি জোরালো করতে।
তাছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিস্তা নদীর পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিস্তা প্রকল্পের আওতায় আছে – নদী খনন করে গভীরতা বাড়ানো, সারা বছর নৌ চলাচলের ব্যবস্থা করা, নদীর দুই তীরে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ।
এ প্রকল্প নিয়ে ভারতের আপত্তির বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।
প্রথমত: ভারত যদি এই প্রকল্পকে স্বাগত জানায়, তাহলে এখানে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের বাধ্যবাধকতা তৈরি হতে পারে এবং সেক্ষত্রে তাদের বিনিয়োগের প্রশ্ন উঠতে পারে।
"এরকম একটা প্রকল্প ঝুলিয়ে রাখা ভালো। সেক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের উপর চাপ বজায় রাখতে পারে," বলছিলেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।
তিনি মনে করেন, তিস্তা ইস্যু সমাধান হয়ে গেলে বাংলাদেশের উপর ভারতের যে প্রভাব, সেটা আর থাকবে না।
অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তখন আর ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকবেনা।
তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নদীর দুই পাশে শহর গড়ে উঠবে, নদী শাসন হবে এবং নদীর নাব্যতা থাকবে। ফলে পুরো এলাকায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে এবং দুই কোটি মানুষের জীবনও বদলে যাবে।
এর ফলে সেখানে চীনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরির পাশাপাশি ভারত-বিরোধী মনোভাব আরো প্রবল হব - বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক আহমেদ।
চীনের প্রভাব বাড়বে?
শেখ হাসিনার সরকারের সাথে ২০০৯ সাল থেকে ভারতের সম্পর্ক বেশ ভালো থাকলেও দেশটিতে চীনের প্রভাব বাড়ছে বলে ভারতের ভেতরে অনেকে মনে করেন। বিষয়টি নিয়ে ভারতের মধ্যে এক ধরণের অস্বস্তিও আছে।
এর আগে ২০২২ সালে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত যখন তিস্তা নদীতে সম্ভাব্য প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন, তখন বিষয়টি নিয়ে বেশ সতর্ক হয়েছিল ভারত। ব্যাপরটিকে তারা ভালো নজরে দেখেনি।
এনিয়ে তখন ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নানা ধরনের রিপোর্ট ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছিল।
তখন ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা লিখেছিল, শেখ হাসিনা যদিও বলেছেন যে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে তিস্তা নদীর পানি বন্টন নিয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসী, তারপরও পানি সমস্যার সমাধান করার জন্য তিনি বিকল্প উপায়ও চিন্তা করছেন।
দ্য টেলিগ্রাফ আরো লিখেছিল - তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ভারতের কৌশলগত উদ্বেগও রয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে চীনের জোরালো উপস্থিতি থাকবে।
কারণ এর কাছাকাছি ভারতের উত্তরবঙ্গে 'চিকেন নেক' বা কম প্রশস্তের জায়গা রয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে বাকি দেশের সংযোগ রয়েছে।
এতো কাছাকাছি চীনের অবস্থান থাকলে সেটি ভারতের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ তৈরি হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
গবেষক অনুসূয়া বসু রায় চৌধুরী বলেন, যে জায়গাটিতে চীন তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে, সেটি ভারতের স্পর্শকাতর এলাকার খুব কাছাকাছি।
"এটা সীমান্তের কাছাকাছি শুধু তাই নয়। শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের সাথে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির সংযোগ স্থাপন করেছে এই শিলিগুড়ি করিডোর। সেজন্য এই জায়গা খুবই সংবেদনশীল," বলছিলেন অনুসূয়া বসু রায়চৌধুরী।
ভারতের সাবেক ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পঙ্কজ সরন সম্প্রতি এক নিবন্ধে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
'বাংলাদেশ ইলেকশনস অ্যান্ড ইট্স আফটারমাথ' শিরোনামে সে নিবন্ধে পঙ্কজ সরন উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়' নীতি অনুসরণ করেছেন।
যদিও চীনের দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে যাওয়া এবং আমেরিকার সাথে শীতল সম্পর্ক তৈরি হবার বিষয়টিতে সে নীতি ফুঁটে ওঠেনি।
পঙ্কজ সরন আরো লিখেছেন, শেখ হাসিনার এবারের মেয়াদে চীনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পশ্চিমের সাথে দুরত্ব কমিয়ে সে সম্পর্ককে উল্টোভাবে চিন্তা করার সুযোগ রয়েছে।
এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভারতের আপত্তির মুখে তিস্তা প্রকল্প চীনের সাথে এগিয়ে নেয়া বাংলাদেশের জন্য সহজ হবেনা। এমনটাই মনে করেছেন অনেকে।
সম্পাদক : মাহমুদ আনোয়ার হোসেন
নির্বাহী সম্পাদক : জুবায়ের রহমান চৌধুরী
বার্তা সম্পাদক : খালেকুজ্জামান পান্নু
বার্তা ও সম্পাদকীয় কার্যালয় : বাড়ি # ৬৩, সড়ক # ২১,
রূপনগর আ/এ, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬।
বাণিজ্যিক কার্যালয় : গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড, ঢাকা-১২১২।
ফোন : 01731-488397,01552381515, 01751345643
হোয়াটসএ্যাপ : 01826567123
Copyright © 2024 সারাবেলার সংবাদ. All rights reserved.