বাংলাদেশের নাগরিক হতে রোহিঙ্গাদের জালিয়াতি
- আপডেট সময় : ১১:২৯:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ৭২ বার পঠিত
এই জালিয়াতির কাজে সহায়তা করছে নির্বাচন কমিশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের এক শ্রেণির কর্মচারি-কর্মকর্তা৷ জালিয়াতির ঘটনা নতুন না হলেও সর্বশেষ আরেকটি চক্রকে আটক করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার অ্যাণ্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিট (দক্ষিণ)৷ তারা যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে তাদের মধ্যে দুইজন হলেন দিনাজপুরের বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ এবং বিরল উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্র৷ তাদের সহায়তা নিয়ে এই জালিয়াতির কাজ করতো এরকম আরো তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তারা হলেন মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম মুন্না, মো. রাসেল খান ও মো. মোস্তাফিজুর রহমান৷
সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিটের (দক্ষিণ) অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. সাইফুর রহমান আজাদ জানান, ‘‘তারা শুধু জন্ম নিবন্ধনের জন্য কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা করে নিত৷ এরপর ন্যাশনাল আইডি কার্ড, পাসপোর্ট এসবের জন্য আলাদা টাকা নিত৷ আমরা জন্ম নিবন্ধন দৈবচয়নের ভিত্তিতে পরীক্ষা করে দেখেছি৷ তারা রোহিঙ্গাদের যেগুলো দিয়েছে তা সার্ভারে আছে৷ শুধু নাম, ঠিকানা পরিবর্তন করে দেওয়া৷ আর এনআইডি আমরা পরীক্ষা করে দেখছি৷”
গোয়েন্দা বিভাগের এই দলটি রোহিঙ্গাদের পাসপোর্টসহ আরো ২৬ জনকে পল্টন এলাকা থেকে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করেছে৷ তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত দুই-এক দিনের মধ্যে জানানো হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা৷
আটক পাঁচজন জানিয়েছেন, তারা রোহিঙ্গাদের দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দেন৷ জন্ম নিবন্ধনের পর জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট পেতেও তারা সহায়তা করেন৷ জন্ম নিবন্ধন হয়ে গেলে ন্যাশনাল আইডি কার্ড ও পাসপোর্টের কাজ সহজ হয়ে যায়৷
এই প্রতারকেরা ফেসবুক ও টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে৷ তারপর দেশের বিভিন্ন এলাকার পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে এনআইডির সঙ্গে যুক্ত কর্মচারিদের অর্থের বিনিময়ে কাজে লাগিয়ে জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দেয়৷
গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, তারা পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটরদের মাধ্যমে পৌর মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে৷ তারা বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ এবং বিরল উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্রকে আটক করলেও কুষ্টিয়ার ভেড়ামাড়া এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি পৌরসভার মেয়র ও চেয়ারম্যানের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেও রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন দেওয়ার তথ্য পেয়েছেন৷
বিরল পৌরসভার মেয়র সবুজার সিদ্দিক জানান, ‘‘কাজের সুবিধার জন্য কম্পিউটার অপারেটর আব্দুর রশিদকে পাসওয়ার্ড দিয়ে রেখেছিলাম৷ এখন সে কী করেছে তা আমার জানা নেই৷ আর সে যে এটা করছে তাও আমি বুঝতে পারিনি৷ সে এইভাবে কতজন রোহিঙ্গাকে জন্ম নিবন্ধন দিয়েছে তা বলতে পারবো না৷ তাকে গোয়েন্দারা ধরে নিয়ে গেছে৷ কম্পিউটারসহ সব ধরনের পাসওয়ার্ডই তার কাছে৷ এখন আমাদের কাজকর্মও বন্ধ আছে৷”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জন্ম নিবন্ধন সার্ভারের পাসওয়ার্ড থাকে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার মেয়র, ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবদের কাছে৷ আর ন্যাশনাল আইডি কার্ডের পাসওয়ার্ড থাকে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে৷ এই দুই জায়গার সার্ভারে প্রতারকরা যে-কোনো উপায়ে ঢুকে রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন ও ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেয়৷ আর এই দুইডি ডকুমেন্ট থাকলে পাসপোর্ট পাওয়া সহজ হয়৷ তারপরও পাসপোর্ট করতে গিয়ে সন্দেহজনত আচরণের কারণে অনেক রোহিঙ্গা ধরা পড়ে৷
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ইয়াসির নামে এক রোহিঙ্গা যুবক আটক হয়েছেন৷ তিনি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার পশ্চিম ঘোড়াশাল ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের জাকির হোসেন ও হাসিনা বেগমের ছেলে পরিচয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে পাসপোর্টের আবেদন করেন৷ ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি তুলতে গিয়ে সন্দেহজনক আচরণের কারণে তিনি ধরা পড়েন৷ ওই যুবক মিয়ানমারের বালি বাজার এলাকার বাসিন্দা৷ তিনি কক্সবাজারের বালুখালি ক্যাম্পে থাকেন৷ ওই ঘটনায় রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করিয়ে দেয়া চক্রের তিন জনকে আটক করা হয়৷ তাদের কাছ থেকে ১৪টি পার্সপোর্ট উদ্ধার করা হয়৷
সম্প্রতি কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ কুড়িগ্রাম ও গাজীপুরেও মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট করতে গিয়ে আটক হয়েছেন৷ জানা গেছে জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট এই পুরো কাজ করতে পাঁচ থেকে আট লাখ টাকায় চুক্তি করেন প্রতারকেরা৷ আবার এটা তারা ধাপে ধাপেও চুক্তি করেন৷ আর মিথ্যা তথ্য দিয়ে এগুলো করা হলেও রোহিঙ্গারা অরিজিন্যাল ডকুমেন্টই পায়৷ তাদের সবকিছুই সার্ভারে থাকে৷ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের কাট্টলি এলাকা থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্টসহ তিন রোহিঙ্গা যুবককে আটক করে পুলিশ৷ তারা নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট করিয়েছিলেন৷
ওই একই বছর (২০১৯ সালে) চট্টগ্রামে জালিয়াতি করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার বড় ঘটনা ধরা পড়ে৷ ওই ঘটনায় তখন নির্বাচন কমিশনের সাতজন কর্মচারীসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ পরে আরো কয়েকজনকে আটক করা হয়৷ তাদের মধ্যে পাঁচজন আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে এনআইডি সার্ভারে ঢুকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার কথা স্বীকার করেন৷ ওই ঘটনায় তখন তিনটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল৷
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনু বিভাগের সিস্টেম ম্যানেজার মো. রফিকুল ইসলাম জানান গাজীপুরেও সম্প্রতি এইধরনের আরেকটি জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে৷ সেটার তদন্ত চলছে৷ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না৷ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মো. রফিক নামে এক রোহিঙ্গা গাজীপুর জেলা নির্বাচন অফিস থেকে ভুয়া পরিচয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছেন৷
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, ‘‘ডিবির হাতে পাঁচজন আটক হওয়ার পর আমরা সারাদেশে সতর্ক বার্তা পাঠিয়েছি৷ আজকের (মঙ্গলবার) মধ্যে জেলা উপজেলার সব পাসওয়ার্ড পরিবর্তন হয়ে যাবে৷ আগে খুব সাধারণ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা হতো, যা হ্যাক হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো৷ এখন আমরা শক্ত পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে বলেছি৷ আলফা নিউমেরিক পাসওয়ার্ড দিতে বলেছি৷ আগে ১, ২, ৩ এভাবে সিরিয়ালি পাসওয়ার্ড দিতো৷”