ঢাকা ১২:০৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo ভোলায় সাংবাদিক ইউনুছ শরীফের উপর হামলা, বিভিন্ন মহলের নিন্দা Logo পাসপোর্ট আনতে গিয়ে সোনারগাঁয়ের দুই যুবক নিহত Logo সৈয়দপুরে গরিব ও দুস্থদের মাঝে কম্বল বিতরণ Logo আইফেল টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড! ১২০০০ পর্যটককে নিরাপদ স্থানে সরান হল Logo সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে: প্রেস সচিব Logo উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ড: শিশুসহ নিহত ২ Logo বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক জোরদারের আশাবাদ প্রণয় ভার্মার Logo আশুলিয়ায় ছয় মরদেহ পোড়ানোর ঘটনায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা Logo অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মার্কিন সমর্থন অব্যাহত থাকবে, ফোনলাপে জ্যাক সুলিভান Logo গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিএনপিতে নেয়া মানা: মির্জা ফখরুল

বাংলাদেশের নাগরিক হতে রোহিঙ্গাদের জালিয়াতি

সারাবেলা প্রতিবেদন
  • আপডেট সময় : ১১:২৯:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ৭২ বার পঠিত

প্রত্যাবাসনের দাবিতে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ৷ ২০১৭ সালের ছবি

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা প্রতারক চক্রের সহায়তায় জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে যাচ্ছেন৷ তাদের কেউ কেউ পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে দেশের বাইরেও যাচ্ছেন৷

এই জালিয়াতির কাজে সহায়তা করছে নির্বাচন কমিশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের এক শ্রেণির কর্মচারি-কর্মকর্তা৷ জালিয়াতির ঘটনা নতুন না হলেও সর্বশেষ আরেকটি চক্রকে আটক করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার অ্যাণ্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিট (দক্ষিণ)৷ তারা যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে তাদের মধ্যে দুইজন হলেন দিনাজপুরের বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ এবং বিরল উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্র৷ তাদের সহায়তা নিয়ে এই জালিয়াতির কাজ করতো এরকম আরো তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তারা হলেন মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম মুন্না, মো. রাসেল খান ও মো. মোস্তাফিজুর রহমান৷

সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিটের (দক্ষিণ) অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. সাইফুর রহমান আজাদ জানান, ‘‘তারা শুধু জন্ম নিবন্ধনের জন্য কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা করে নিত৷ এরপর ন্যাশনাল আইডি কার্ড, পাসপোর্ট এসবের জন্য আলাদা টাকা নিত৷ আমরা জন্ম নিবন্ধন দৈবচয়নের ভিত্তিতে পরীক্ষা করে দেখেছি৷ তারা রোহিঙ্গাদের যেগুলো দিয়েছে তা সার্ভারে আছে৷ শুধু নাম, ঠিকানা পরিবর্তন করে দেওয়া৷ আর এনআইডি আমরা পরীক্ষা করে দেখছি৷”

গোয়েন্দা বিভাগের এই দলটি রোহিঙ্গাদের পাসপোর্টসহ আরো ২৬ জনকে পল্টন এলাকা থেকে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করেছে৷ তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত দুই-এক দিনের মধ্যে জানানো হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা৷
আটক পাঁচজন জানিয়েছেন, তারা রোহিঙ্গাদের দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দেন৷ জন্ম নিবন্ধনের পর জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট পেতেও তারা সহায়তা করেন৷ জন্ম নিবন্ধন হয়ে গেলে ন্যাশনাল আইডি কার্ড ও পাসপোর্টের কাজ সহজ হয়ে যায়৷

আটকদের মধ্যে দুইজন জানিয়েছেন, তার কক্সবাজার এলাকায় এক হাজার ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসাবে জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দিয়েছেন৷

এই প্রতারকেরা ফেসবুক ও টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে৷ তারপর দেশের বিভিন্ন এলাকার পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে এনআইডির সঙ্গে যুক্ত কর্মচারিদের অর্থের বিনিময়ে কাজে লাগিয়ে জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দেয়৷

গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, তারা পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটরদের মাধ্যমে পৌর মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে৷ তারা বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ এবং বিরল উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্রকে আটক করলেও কুষ্টিয়ার ভেড়ামাড়া এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি পৌরসভার মেয়র ও চেয়ারম্যানের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেও রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন দেওয়ার তথ্য পেয়েছেন৷
বিরল পৌরসভার মেয়র সবুজার সিদ্দিক জানান, ‘‘কাজের সুবিধার জন্য কম্পিউটার অপারেটর আব্দুর রশিদকে পাসওয়ার্ড দিয়ে রেখেছিলাম৷ এখন সে কী করেছে তা আমার জানা নেই৷ আর সে যে এটা করছে তাও আমি বুঝতে পারিনি৷ সে এইভাবে কতজন রোহিঙ্গাকে জন্ম নিবন্ধন দিয়েছে তা বলতে পারবো না৷ তাকে গোয়েন্দারা ধরে নিয়ে গেছে৷ কম্পিউটারসহ সব ধরনের পাসওয়ার্ডই তার কাছে৷ এখন আমাদের কাজকর্মও বন্ধ আছে৷”

বিরলের রানীপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আল্লামা আজাদ ইকবাল বলেন, ‘‘আমার কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্র দুই বছর ধরে এখানে কাজ করছে৷ সে আমাদের বিশ্বস্ত ছিলো৷ এত বড় জালিয়াতি করবে বুঝতে পারিনি৷ সে ছাড়া আমাদের পৌরসভার আর কোনো কর্মচারি এরসঙ্গে জড়িত নয়৷”

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জন্ম নিবন্ধন সার্ভারের পাসওয়ার্ড থাকে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার মেয়র, ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবদের কাছে৷ আর ন্যাশনাল আইডি কার্ডের পাসওয়ার্ড থাকে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে৷ এই দুই জায়গার সার্ভারে প্রতারকরা যে-কোনো উপায়ে ঢুকে রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন ও ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেয়৷ আর এই দুইডি ডকুমেন্ট থাকলে পাসপোর্ট পাওয়া সহজ হয়৷ তারপরও পাসপোর্ট করতে গিয়ে সন্দেহজনত আচরণের কারণে অনেক রোহিঙ্গা ধরা পড়ে৷

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ইয়াসির নামে এক রোহিঙ্গা যুবক আটক হয়েছেন৷ তিনি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার পশ্চিম ঘোড়াশাল ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের জাকির হোসেন ও হাসিনা বেগমের ছেলে পরিচয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে পাসপোর্টের আবেদন করেন৷ ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি তুলতে গিয়ে সন্দেহজনক আচরণের কারণে তিনি ধরা পড়েন৷ ওই যুবক মিয়ানমারের বালি বাজার এলাকার বাসিন্দা৷ তিনি কক্সবাজারের বালুখালি ক্যাম্পে থাকেন৷ ওই ঘটনায় রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করিয়ে দেয়া চক্রের তিন জনকে আটক করা হয়৷ তাদের কাছ থেকে ১৪টি পার্সপোর্ট উদ্ধার করা হয়৷

সম্প্রতি কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ কুড়িগ্রাম ও গাজীপুরেও মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট করতে গিয়ে আটক হয়েছেন৷ জানা গেছে জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট এই পুরো কাজ করতে পাঁচ থেকে আট লাখ টাকায় চুক্তি করেন প্রতারকেরা৷ আবার এটা তারা ধাপে ধাপেও চুক্তি করেন৷ আর মিথ্যা তথ্য দিয়ে এগুলো করা হলেও রোহিঙ্গারা অরিজিন্যাল ডকুমেন্টই পায়৷ তাদের সবকিছুই সার্ভারে থাকে৷ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের কাট্টলি এলাকা থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্টসহ তিন রোহিঙ্গা যুবককে আটক করে পুলিশ৷ তারা নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট করিয়েছিলেন৷

ওই একই বছর (২০১৯ সালে) চট্টগ্রামে জালিয়াতি করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার বড় ঘটনা ধরা পড়ে৷ ওই ঘটনায় তখন নির্বাচন কমিশনের সাতজন কর্মচারীসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ পরে আরো কয়েকজনকে আটক করা হয়৷ তাদের মধ্যে পাঁচজন আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে এনআইডি সার্ভারে ঢুকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার কথা স্বীকার করেন৷ ওই ঘটনায় তখন তিনটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল৷

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনু বিভাগের সিস্টেম ম্যানেজার মো. রফিকুল ইসলাম জানান গাজীপুরেও সম্প্রতি এইধরনের আরেকটি জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে৷ সেটার তদন্ত চলছে৷ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না৷ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মো. রফিক নামে এক রোহিঙ্গা গাজীপুর জেলা নির্বাচন অফিস থেকে ভুয়া পরিচয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছেন৷

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, ‘‘ডিবির হাতে পাঁচজন আটক হওয়ার পর আমরা সারাদেশে সতর্ক বার্তা পাঠিয়েছি৷ আজকের (মঙ্গলবার) মধ্যে জেলা উপজেলার সব পাসওয়ার্ড পরিবর্তন হয়ে যাবে৷ আগে খুব সাধারণ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা হতো, যা হ্যাক হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো৷ এখন আমরা শক্ত পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে বলেছি৷ আলফা নিউমেরিক পাসওয়ার্ড দিতে বলেছি৷ আগে ১, ২, ৩ এভাবে সিরিয়ালি পাসওয়ার্ড দিতো৷”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘২০১৯ সালে চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেয়ার ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলছে৷ কয়েকজনের চাকরি চলে গেছে৷ কয়েকজন সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন৷” ডয়চে ভেলে
Facebook Comments Box
ট্যাগস :

বাংলাদেশের নাগরিক হতে রোহিঙ্গাদের জালিয়াতি

আপডেট সময় : ১১:২৯:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা প্রতারক চক্রের সহায়তায় জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে যাচ্ছেন৷ তাদের কেউ কেউ পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে দেশের বাইরেও যাচ্ছেন৷

এই জালিয়াতির কাজে সহায়তা করছে নির্বাচন কমিশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের এক শ্রেণির কর্মচারি-কর্মকর্তা৷ জালিয়াতির ঘটনা নতুন না হলেও সর্বশেষ আরেকটি চক্রকে আটক করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার অ্যাণ্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিট (দক্ষিণ)৷ তারা যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে তাদের মধ্যে দুইজন হলেন দিনাজপুরের বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ এবং বিরল উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্র৷ তাদের সহায়তা নিয়ে এই জালিয়াতির কাজ করতো এরকম আরো তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তারা হলেন মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম মুন্না, মো. রাসেল খান ও মো. মোস্তাফিজুর রহমান৷

সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিটের (দক্ষিণ) অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. সাইফুর রহমান আজাদ জানান, ‘‘তারা শুধু জন্ম নিবন্ধনের জন্য কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা করে নিত৷ এরপর ন্যাশনাল আইডি কার্ড, পাসপোর্ট এসবের জন্য আলাদা টাকা নিত৷ আমরা জন্ম নিবন্ধন দৈবচয়নের ভিত্তিতে পরীক্ষা করে দেখেছি৷ তারা রোহিঙ্গাদের যেগুলো দিয়েছে তা সার্ভারে আছে৷ শুধু নাম, ঠিকানা পরিবর্তন করে দেওয়া৷ আর এনআইডি আমরা পরীক্ষা করে দেখছি৷”

গোয়েন্দা বিভাগের এই দলটি রোহিঙ্গাদের পাসপোর্টসহ আরো ২৬ জনকে পল্টন এলাকা থেকে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করেছে৷ তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত দুই-এক দিনের মধ্যে জানানো হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা৷
আটক পাঁচজন জানিয়েছেন, তারা রোহিঙ্গাদের দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দেন৷ জন্ম নিবন্ধনের পর জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট পেতেও তারা সহায়তা করেন৷ জন্ম নিবন্ধন হয়ে গেলে ন্যাশনাল আইডি কার্ড ও পাসপোর্টের কাজ সহজ হয়ে যায়৷

আটকদের মধ্যে দুইজন জানিয়েছেন, তার কক্সবাজার এলাকায় এক হাজার ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসাবে জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দিয়েছেন৷

এই প্রতারকেরা ফেসবুক ও টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে৷ তারপর দেশের বিভিন্ন এলাকার পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে এনআইডির সঙ্গে যুক্ত কর্মচারিদের অর্থের বিনিময়ে কাজে লাগিয়ে জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দেয়৷

গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, তারা পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটরদের মাধ্যমে পৌর মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে৷ তারা বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ এবং বিরল উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্রকে আটক করলেও কুষ্টিয়ার ভেড়ামাড়া এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি পৌরসভার মেয়র ও চেয়ারম্যানের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেও রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন দেওয়ার তথ্য পেয়েছেন৷
বিরল পৌরসভার মেয়র সবুজার সিদ্দিক জানান, ‘‘কাজের সুবিধার জন্য কম্পিউটার অপারেটর আব্দুর রশিদকে পাসওয়ার্ড দিয়ে রেখেছিলাম৷ এখন সে কী করেছে তা আমার জানা নেই৷ আর সে যে এটা করছে তাও আমি বুঝতে পারিনি৷ সে এইভাবে কতজন রোহিঙ্গাকে জন্ম নিবন্ধন দিয়েছে তা বলতে পারবো না৷ তাকে গোয়েন্দারা ধরে নিয়ে গেছে৷ কম্পিউটারসহ সব ধরনের পাসওয়ার্ডই তার কাছে৷ এখন আমাদের কাজকর্মও বন্ধ আছে৷”

বিরলের রানীপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আল্লামা আজাদ ইকবাল বলেন, ‘‘আমার কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্র দুই বছর ধরে এখানে কাজ করছে৷ সে আমাদের বিশ্বস্ত ছিলো৷ এত বড় জালিয়াতি করবে বুঝতে পারিনি৷ সে ছাড়া আমাদের পৌরসভার আর কোনো কর্মচারি এরসঙ্গে জড়িত নয়৷”

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জন্ম নিবন্ধন সার্ভারের পাসওয়ার্ড থাকে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার মেয়র, ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবদের কাছে৷ আর ন্যাশনাল আইডি কার্ডের পাসওয়ার্ড থাকে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে৷ এই দুই জায়গার সার্ভারে প্রতারকরা যে-কোনো উপায়ে ঢুকে রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন ও ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেয়৷ আর এই দুইডি ডকুমেন্ট থাকলে পাসপোর্ট পাওয়া সহজ হয়৷ তারপরও পাসপোর্ট করতে গিয়ে সন্দেহজনত আচরণের কারণে অনেক রোহিঙ্গা ধরা পড়ে৷

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ইয়াসির নামে এক রোহিঙ্গা যুবক আটক হয়েছেন৷ তিনি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার পশ্চিম ঘোড়াশাল ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের জাকির হোসেন ও হাসিনা বেগমের ছেলে পরিচয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে পাসপোর্টের আবেদন করেন৷ ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি তুলতে গিয়ে সন্দেহজনক আচরণের কারণে তিনি ধরা পড়েন৷ ওই যুবক মিয়ানমারের বালি বাজার এলাকার বাসিন্দা৷ তিনি কক্সবাজারের বালুখালি ক্যাম্পে থাকেন৷ ওই ঘটনায় রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করিয়ে দেয়া চক্রের তিন জনকে আটক করা হয়৷ তাদের কাছ থেকে ১৪টি পার্সপোর্ট উদ্ধার করা হয়৷

সম্প্রতি কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ কুড়িগ্রাম ও গাজীপুরেও মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট করতে গিয়ে আটক হয়েছেন৷ জানা গেছে জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট এই পুরো কাজ করতে পাঁচ থেকে আট লাখ টাকায় চুক্তি করেন প্রতারকেরা৷ আবার এটা তারা ধাপে ধাপেও চুক্তি করেন৷ আর মিথ্যা তথ্য দিয়ে এগুলো করা হলেও রোহিঙ্গারা অরিজিন্যাল ডকুমেন্টই পায়৷ তাদের সবকিছুই সার্ভারে থাকে৷ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের কাট্টলি এলাকা থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্টসহ তিন রোহিঙ্গা যুবককে আটক করে পুলিশ৷ তারা নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট করিয়েছিলেন৷

ওই একই বছর (২০১৯ সালে) চট্টগ্রামে জালিয়াতি করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার বড় ঘটনা ধরা পড়ে৷ ওই ঘটনায় তখন নির্বাচন কমিশনের সাতজন কর্মচারীসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ পরে আরো কয়েকজনকে আটক করা হয়৷ তাদের মধ্যে পাঁচজন আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে এনআইডি সার্ভারে ঢুকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার কথা স্বীকার করেন৷ ওই ঘটনায় তখন তিনটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল৷

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনু বিভাগের সিস্টেম ম্যানেজার মো. রফিকুল ইসলাম জানান গাজীপুরেও সম্প্রতি এইধরনের আরেকটি জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে৷ সেটার তদন্ত চলছে৷ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না৷ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মো. রফিক নামে এক রোহিঙ্গা গাজীপুর জেলা নির্বাচন অফিস থেকে ভুয়া পরিচয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছেন৷

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, ‘‘ডিবির হাতে পাঁচজন আটক হওয়ার পর আমরা সারাদেশে সতর্ক বার্তা পাঠিয়েছি৷ আজকের (মঙ্গলবার) মধ্যে জেলা উপজেলার সব পাসওয়ার্ড পরিবর্তন হয়ে যাবে৷ আগে খুব সাধারণ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা হতো, যা হ্যাক হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো৷ এখন আমরা শক্ত পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে বলেছি৷ আলফা নিউমেরিক পাসওয়ার্ড দিতে বলেছি৷ আগে ১, ২, ৩ এভাবে সিরিয়ালি পাসওয়ার্ড দিতো৷”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘২০১৯ সালে চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেয়ার ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলছে৷ কয়েকজনের চাকরি চলে গেছে৷ কয়েকজন সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন৷” ডয়চে ভেলে
Facebook Comments Box