প্রিন্ট এর তারিখঃ অক্টোবর ১৯, ২০২৪, ৫:২৮ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ৬, ২০২৪, ১১:৫৬ পি.এম
ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের কিছু আলোচিত মামলার বিচার এখন যে অবস্থায়
দেশে বিভিন্ন সময়ে ধর্ষণের অভিযোগে বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে আলোড়ন ওঠে। এসব ঘটনার বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, মানবাধিকার কর্মী এবং সাধারণ জনগণ নামে আন্দোলনে।
এমন কী, এসব ঘটনার বিচার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সরব হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীরা।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আবারো ধর্ষণের এমন একটি অভিযোগকে কেন্দ্র করে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা।
প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, গত কয়েক বছরে আলোচনায় আসা এরকম বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনার বিচার কোন অবস্থায় রয়েছে?
সিলেটে এমসি কলেজে তরুণী ধর্ষণের মামলা
২০২০ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার দিকে সিলেটের টিলাগড় এলাকার এমসি কলেজের সামনে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে যান এক যুবক। পরে গেটের সামনে থেকে তার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যায় কয়েকজন।
ঐ তরুণী তার স্বামীর সাথে একটি গাড়িতে করে বেড়াতে গিয়েছিলেন। পরে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, তার স্ত্রীকে যখন জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তখন দুই ব্যক্তি স্বামীকে গাড়িতে আটক করে রাখে।
এর ঘণ্টাখানেক পর এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের একটি কক্ষের সামনে থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজের স্ত্রীকে উদ্ধার করেন ওই যুবক।
পরে রাতেই ঐ তরুণীকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়।
সে সময়, এমসি কলেজের হোস্টেলের পাশের আবাসিক এলাকার এক বাসিন্দা জানান, রাতে বেশ কিছুক্ষণ ছাত্রাবাসের ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি।
পরে এক পর্যায়ে নারী কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে স্থানীয় আরো কয়েকজনকে নিয়ে ছাত্রাবাস এলাকার ভেতরে প্রবেশ করেন।
সে সময় হোস্টেলের পাশের স্টাফ কোয়ার্টার থেকে কর্মচারীরা জড়ো হলে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারেন তারা।
এই ঘটনায় এমসি কলেজের আটজন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অভিযোগ গঠন করে সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল।
ঘটনার পর ডিএনএ পরীক্ষা করে চার আসামির সাথে ডিএনএ ম্যাচিং পাওয়া যায়।
সে সময় চাঞ্চল্যকর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য গঠিত জেলা মনিটরিং কমিটি মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু কোনও পদক্ষেপ না থাকায় ভুক্তভোগী তরুণীর স্বামী হাইকোর্টে রিট করেন।
পরে ওই বছরেরই ১৫ই ডিসেম্বর মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বদলি করতে আদেশ দেয় হাইকোর্ট। কিন্তু মামলা স্থানান্তর করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখনো গেজেট জারি করা হয় নি।
মামলার বাদীর আইনজীবী শহীদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, “দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা স্থানান্তরে হাইকোর্টের আদেশ এখনো কার্যকর হয় নাই।
হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আবার লিভ টু আপিল করে। ফলে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি এখনও”।
শহীদুজ্জামান চৌধুরী জানান, “এখন মামলার বাদীকেও প্রলুব্ধ করার চেষ্টা চলছে। মনে হচ্ছে তাকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। তিনিও এখন আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।”
[caption id="attachment_15072" align="aligncenter" width="300"] ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে আন্দোলন[/caption]
নোয়াখালিতে গৃহবধূকে ধর্ষণ ও ভিডিও করে ছড়িয়ে দেয়ার মামলা
নোয়াখালীতে বেগমগঞ্জ উপজেলায় ২০২০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর একটি গ্রামে একজন গৃহবধূর বাড়িতে ঢুকে তার স্বামীকে পাশের কক্ষে আটকে রেখে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে স্থানীয় কয়েকজন যুবক।
প্রায় একমাস পরে সেই নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
এরপরেই নয় জনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন নির্যাতনের শিকার ওই নারী।
এছাড়া নির্যাতনের ওই ভিডিও ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পর্নগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে আরেকটি মামলা করা হয়।
২০২১ সালের ৪ঠা অক্টোবর এই মামলায় দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় নোয়াখালির নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করেছে বলে জানান আইনজীবীরা।
এরই মধ্যে, সোমবার সুবর্ণচরে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে একজন গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় ১০ অভিযুক্তকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।অন্য ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের রাতে ওই ধর্ষণের ঘটনা ঘটায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় তখন।
ভুক্তভোগী ওই নারী সেই সময় অভিযোগ করেছিলেন, ভোটকেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের পছন্দের নৌকার প্রতীকে ভোট না দেওয়ার রোষে ওই হামলা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
রায়ের পরই আসামিপক্ষের আইনজীবী আপিল করার কথা জানিয়েছেন।
[caption id="attachment_15073" align="aligncenter" width="300"] তনু হত্যাকাণ্ডের পর বিচারের দাবীতে জোরালো আন্দোলন হয়েছিলো[/caption]
কুমিল্লায় তনু হত্যা মামলা
কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকা থেকে ২০১৬ সালের ২০শে মার্চ সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনু সেনানিবাসের একটি বাসায় প্রাইভেট পড়াতে যেতেন।
সেই বাসার পার্শ্ববর্তী জঙ্গল থেকে তার মরদেহ পাওয়া যায়। পরদিন বিকেলে তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় মামলা করে।
সে সময় পুলিশ ধারণা করেছিলো, তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
তনু হত্যাকাণ্ডের পর বিচারের দাবিতে তার কলেজের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জোরালো আন্দোলন করেছিলো।
তার মরদেহের দুই দফায় ময়না তদন্ত হয়েছে। প্রথম ময়না তদন্তের প্রতিবেদনে ধর্ষণের কোনও আলামত পাওয়া যায়নি এবং তনু কেন মারা গেছে তাও সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয় নি।
দ্বিতীয় দফায় কবর থেকে মরদেহ তুলে ময়না তদন্ত হয়েছে।
গত আট বছরে মামলার পাঁচবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়েছে। পুলিশ, সিআইডি পর এখন এর তদন্ত করছে পিবিআই।
২০১৬ সালে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি নিহত তনুর শরীর থেকে নেওয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে ধর্ষণের আলামত পাওয়ার কথা জানায়।
সে সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির কুমিল্লার বিশেষ পুলিশ সুপার নাজমুল করিম খান বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্টে মোট চারজনের ডিএনএ প্রোফাইলের কথা বলা হয়েছে।"
"এর মধ্যে একটি প্রোফাইল তনুর রক্তের, যেটি তাঁর দাঁত থেকে করা ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে মিলে গেছে”।
“অপর তিনটি প্রোফাইল তিনজন পুরুষের, যাতে তিনজনের স্পার্মাটোজোয়া বা বীর্যের আলামত পাওয়া গেছে। ফলে সিআইডি সন্দেহ করছে হত্যার আগে তনুকে ধর্ষণ করা হয়েছিল” বলেছিলেন নাজমুল করিম খান।
সবশেষ ২০২০ সালের ২১শে অক্টোবর মামলাটি সিআইডি থেকে পিবিআই-এর কাছে স্থানান্তর করা হয়।
স্থানান্তরের প্রায় আড়াই বছর পর গত বছরের আগস্টে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ঠিক করেও নেয়া হয়নি সাক্ষ্য।
পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান বলেন, “ইনভেস্টিগেশন চলছে এখনও। আরও সাক্ষ্য নেয়ার প্রয়োজন আছে। তদন্ত পর্যায়ে বিস্তারিত বলা যাবে না”।
“তবে, আরও গভীরভাবে তথ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হচ্ছে ” বলে জানান মুজিবুর রহমান।
অর্থাৎ আট বছর পরও এ ঘটনার তদন্ত শেষ হয় নি।
[caption id="attachment_15074" align="aligncenter" width="300"] নুসরাত জাহান রাফি[/caption]
ফেনীর নুসরাত হত্যা মামলা
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে ২০১৯ সালের ২৬শে মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা তার অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন।
এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে পরদিন সোনাগাজী মডেল থানায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাকে আসামি করে মামলা করেন।
ওই দিনই অধ্যক্ষ সিরাজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার না করায় অনুসারীরা ঘটনার ১০ দিন পর নুসরাতকে পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে ছাদে ডেকে নিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ই এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নুসরাতের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন।
ওই বছরই ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ১৬জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানা করে।
এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের করা আপিল উচ্চ আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানান আইনজীবীরা।
নুসরাতকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও ধারণ করে তা প্রচারের ঘটনায় করা মামলায় সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে একই বছর আট বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত।
বাংলাদেশে বছর চারেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের এমনই এক প্রেক্ষাপটে আন্দোলনের মুখে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করেছে।
বিশ্বের সপ্তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে।
আইনে নির্ধারিত সময় থাকলেও বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলাগুলোতে বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতা থাকে বছরের পর বছর।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “ক্রিমিনাল মামলাগুলোর তদন্ত দীর্ঘায়িত হওয়া থেকে শুরু করে সাক্ষী হাজির করতে না পারা-সহ প্রক্রিয়াগত বিষয়গুলি রাষ্ট্রীয় এজেন্সির বিষয়।"
"এক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্যও রাষ্ট্র কতটুকু করতে পারছে তার ওপর নির্ভর করে। তারা কতটুকু কাজ করতে পারছে, কাকে প্রাধান্য দেবে এটাও অনেক সময় হয়। ফলে সব কিছু মিলিয়ে বিচার বিলম্বিত হয়।”
“তদন্ত থেকে শুরু করে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি সব বিষয়ে এক্ষেত্রে দায়ী থাকে রাষ্ট্র” বলেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। বিবিসি
সম্পাদক : মাহমুদ আনোয়ার হোসেন
নির্বাহী সম্পাদক : জুবায়ের রহমান চৌধুরী
বার্তা সম্পাদক : খালেকুজ্জামান পান্নু
বার্তা ও সম্পাদকীয় কার্যালয় : বাড়ি # ৬৩, সড়ক # ২১,
রূপনগর আ/এ, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬।
বাণিজ্যিক কার্যালয় : গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড, ঢাকা-১২১২।
ফোন : 01731-488397,01552381515, 01751345643
হোয়াটসএ্যাপ : 01826567123
Copyright © 2024 সারাবেলার সংবাদ. All rights reserved.