ঢাকা ০৯:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

ত্রিমুখী যোগসাজশে সরকারি ক্রয় : টিআইবি

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
  • আপডেট সময় : ১২:২৬:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৭ বার পঠিত
ঢাকা: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং ঠিকাদারদের মধ্যে ব্যাপক যোগসাজশ হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) এখনো প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারছে না। শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার ৩০ শতাংশ ই-কন্ট্রাক্ট নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাজারে তাদের আধিপত্য বাড়ছে।
সোমবার ( ২৫ সেপ্টেম্বর ) রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে ‘সরকারি ক্রয়ে সুশাসন: বাংলাদেশে ই-জিপি’র কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এ লক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ই-জিপি কার্যকরে ৬ দফা সুপারিশ করে টিআইবি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবল একজন ঠিকাদার অংশ নিয়েছিলেন, এমন দরপত্রের মাধ্যমে গত ১১ বছরে ৬০ হাজার ৬৯ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। ই-জিপি ব্যবস্থার মাধ্যমে এসব দরপত্রের প্রতিটিতে একজন ঠিকাদার অংশ নিয়েছিলেন এবং সেই ঠিকাদারই কাজ পেয়েছিলেন। এ ধরনের চর্চায় দুর্নীতির ঝুঁকি বাড়ে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং সংস্থাটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় মূল প্রতিবেদন উপাস্থাপন করেন একই বিভাগের কোর্ডিনেটর মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যদিও ই-জিপি সরকারের পক্ষ থেকে একটি ইতিবাচক উদ্যোগ ছিল এবং অর্থ ও সময় সাশ্রয় করেছে, তবুও কার্যকরে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়নি। সরকারি ক্রয় ব্যবস্থায় বাজার দখল এখন প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে গেছে। ই-জিপি প্ল্যাটফর্মে প্রায় ৭৫ শতাংশ দরপত্র একক দরদাতাদের মাধ্যমে দখল করা হয়েছে।
মূল বক্তব্যে বলা হয়, ২০১২ সাল থেকে প্রায় ২০-৩৫ শতাংশ সরকারি ক্রয় ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। তবে উচ্চমূল্যের চুক্তি এর আওতায় ছিল না। ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সম্পাদিত ৯৯ শতাংশের দরপত্র মূল্য ২৫ কোটি টাকার নিচে। অর্থাৎ বড় চুক্তিমূল্যের দরপত্র এখনো পুরোপুরি এ প্রক্রিয়ার আওতায় আসেনি। অন্যদিকে শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদারের কাজের হিস্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। গড়ে প্রায় ৩০ ভাগ কাজের নিয়ন্ত্রণই এসব ঠিকাদারের হাতে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এ গবেষণাটি সরকারি ই-কেনাকাটায় প্রতিযোগিতার মাত্রা এবং একক দরপত্র পড়ার প্রবণতা চিহ্নিতকরণ; বাজার দখলের মাত্রা বিশ্লেষণ ও সরকারি ই-ক্রয় কার্যক্রমে প্রতিযোগিতা বাড়াতে করণীয় নিয়ে প্রস্তাব দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। গবেষণায় ই-জিপি পোর্টালে থাকা ২০১২-২০২৩ সালের ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত প্রাপ্ত সব ই-কার্যাদেশ (৪ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩৩টি) বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারি ই-ক্রয়কার্যের ৯৬ ভাগের বেশি কেনাকাটা হয় দুটি পদ্ধতিতে।
এর একটি উম্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি, অন্যটি সীমিত দরপত্র পদ্ধতি। উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ৫৩ ভাগ এবং ৪৩ ভাগ হয়েছে সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে। ই-ক্রয়কার্যে শীর্ষে স্থানীয় সরকার বিভাগ (মোট কার্যাদেশের ৪৪ শতাংশ এবং চুক্তি মূল্যের ৪১ শতাংশ)। যা ই-কেনাকাটার ৯৩ শতাংশ (মোট কার্যাদেশ) আর মূল্যের দিক থেকে ৯৭ শতাংশ।
এসব মূলত ১০টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ই-জিপি সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ায় দরপত্র পড়ার হার আপাতদৃষ্টিতে বাড়ালেও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র জমার গড় মাত্র ৩ দশমিক ৫৩ ভাগ। যেখানে সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে এই গড় ৪৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ডেটা বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে ১০ শতাংশের মূল্যসীমা সীমিত দরপত্র পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। যেখানে কাজ পেতে পূর্ব অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয় না।
যা বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ বিনষ্ট করছে। বিশ্লেষণ বলছে, ই-ক্রয় কার্যক্রমে ৪৬ ভাগ ক্ষেত্রে দরপত্র পড়ে ৪টির কম। উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে এ হার ৬৫ ভাগ, যা ক্রয় প্রক্রিয়ায় কম মাত্রার প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত করে। শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদারের কাজের হিস্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। গড়ে ২৬ ভাগের বেশি কাজ পাচ্ছে এসব বড় ঠিকাদার। নিচের দিকের ১০ শতাংশ ঠিকাদার পাচ্ছে মাত্র ২ থেকে ৩ ভাগ কাজ।
সীমিত দরপত্র পদ্ধতি উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। সার্বিকভাবে, ১৯ শতাংশ ক্ষেত্রে দরপত্র পড়েছে মাত্র একটি। অর্থাৎ প্রতি পাঁচটি দরপত্রের একটি একক দরপত্রের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে এই হার ২৬ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি চারটির একটিই একক দরপত্র।
সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে এই হার মাত্র ১১ শতাংশ। গবেষণা প্রতিবেদনে কাজের ভিত্তিতে একক দরপত্রপ্রবণ শীর্ষ ১০টি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের তালিকাও দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নোয়াখালী সদর উপজেলার প্রকৌশল অফিস, হবিগঞ্জের বিপিডিবির বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ-৫, সোনাইমুড়ী পৌরসভা; চট্টগ্রামের বিপিডিবির বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ-৫, মাধবদী পৌরসভা, গৌরনদী পৌরসভা, ফেনীর পৌরসভা বিভাগ, সিলেটের বিপিডিবির বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ-৫ এবং সিলেটের বিপিডিবির বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ-৩।
একইভাবে টাকার অঙ্কে একক দরপত্রে কাজ পাওয়া শীর্ষ ঠিকাদার হলো ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, নাভানা লিমিটেড, মেসার্স আহসান এন্টারপ্রাইজ, ক্রিয়েটিভ ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড, র‌্যাংগস লিমিটেড, মেসার্স এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ফন ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স বকলি এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ভূঁইয়া বিল্ডার্স ও মেসার্স তেলিখালী কনস্ট্রাকশন।
গবেষণায় এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক কারা, তা বলা হয়নি। ফেনী ও নোয়াখালী সবচেয়ে বেশি একক দরপত্রপ্রবণ জেলা, এই দুই জেলায় প্রতি ২টি কার্যাদেশের একটি একক দরপত্র। এরপরই রয়েছে কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ, এই দুই জেলায় প্রতি তিনটির একটি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে একক দরপত্রের মাধ্যমে। এই তালিকায় ঢাকা জেলার অবস্থান পঞ্চম।
একক দরপত্র পড়ার হার ২৮ ভাগের বেশি। জেলাগুলোর মধ্যে একক দরপত্র সবচেয়ে কম পড়ে শরীয়তপুরে, প্রায় ৫ ভাগের কম। এরপরই রয়েছে  ঠাকুরগাঁওয়ের অবস্থান ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। সিটি করপোরেশনগুলোতে একক দরপত্র পড়ার হার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ৬২ দশমিক ৭০ শতাংশ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৫৫ দশমিক ২১ শতাংশ, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন ৪২ দশমিক ১৭ শতাংশ, গাজীপুর সিটি করপোরেশন ৩২ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ৩১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বিশ্লেষণের আলোকে ই-জিপিকে যোগসাজশমুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক করার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য টিআইবি ৬টি সুপারিশ উত্থাপন করছে। এগুলো হলো ইজিপির আওতার বাইরে থাকা উচ্চ চুক্তিমূল্যের সব দরপত্র দ্রুততার সঙ্গে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় আনতে হবে। সরকারি ক্রয় প্রতিযোগিতার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি এবং সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে আরোপিত মূল্যসীমা প্রত্যাহার করতে হবে।
সীমিত দরপত্র পদ্ধতি অনুসরণের বর্তমান ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ঢেলে সাজিয়ে সরকারি ক্রয় আইন ২০০৬-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিতে এবং সম্ভাব্য যোগসাজশ বন্ধে একক দরপত্রপ্রবণ ক্রয় অফিসগুলোকে নজরদারির ভেতর আনতে হবে। সব ক্রয় কর্তৃপক্ষ এবং সিপিটিইউ সরকারি ক্রয় প্রতিযোগিতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। উপাত্তনির্ভর বিশ্লেষণ এবং এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে জোরদার করতে হবে।
সারাবেলার সংবাদ/ এমএএইচ/ ২৫ সেপ্টম্বর ২০২৩
Facebook Comments Box
ট্যাগস :

ত্রিমুখী যোগসাজশে সরকারি ক্রয় : টিআইবি

আপডেট সময় : ১২:২৬:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ঢাকা: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং ঠিকাদারদের মধ্যে ব্যাপক যোগসাজশ হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) এখনো প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারছে না। শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার ৩০ শতাংশ ই-কন্ট্রাক্ট নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাজারে তাদের আধিপত্য বাড়ছে।
সোমবার ( ২৫ সেপ্টেম্বর ) রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে ‘সরকারি ক্রয়ে সুশাসন: বাংলাদেশে ই-জিপি’র কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এ লক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ই-জিপি কার্যকরে ৬ দফা সুপারিশ করে টিআইবি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবল একজন ঠিকাদার অংশ নিয়েছিলেন, এমন দরপত্রের মাধ্যমে গত ১১ বছরে ৬০ হাজার ৬৯ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। ই-জিপি ব্যবস্থার মাধ্যমে এসব দরপত্রের প্রতিটিতে একজন ঠিকাদার অংশ নিয়েছিলেন এবং সেই ঠিকাদারই কাজ পেয়েছিলেন। এ ধরনের চর্চায় দুর্নীতির ঝুঁকি বাড়ে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং সংস্থাটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় মূল প্রতিবেদন উপাস্থাপন করেন একই বিভাগের কোর্ডিনেটর মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যদিও ই-জিপি সরকারের পক্ষ থেকে একটি ইতিবাচক উদ্যোগ ছিল এবং অর্থ ও সময় সাশ্রয় করেছে, তবুও কার্যকরে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়নি। সরকারি ক্রয় ব্যবস্থায় বাজার দখল এখন প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে গেছে। ই-জিপি প্ল্যাটফর্মে প্রায় ৭৫ শতাংশ দরপত্র একক দরদাতাদের মাধ্যমে দখল করা হয়েছে।
মূল বক্তব্যে বলা হয়, ২০১২ সাল থেকে প্রায় ২০-৩৫ শতাংশ সরকারি ক্রয় ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। তবে উচ্চমূল্যের চুক্তি এর আওতায় ছিল না। ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সম্পাদিত ৯৯ শতাংশের দরপত্র মূল্য ২৫ কোটি টাকার নিচে। অর্থাৎ বড় চুক্তিমূল্যের দরপত্র এখনো পুরোপুরি এ প্রক্রিয়ার আওতায় আসেনি। অন্যদিকে শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদারের কাজের হিস্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। গড়ে প্রায় ৩০ ভাগ কাজের নিয়ন্ত্রণই এসব ঠিকাদারের হাতে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এ গবেষণাটি সরকারি ই-কেনাকাটায় প্রতিযোগিতার মাত্রা এবং একক দরপত্র পড়ার প্রবণতা চিহ্নিতকরণ; বাজার দখলের মাত্রা বিশ্লেষণ ও সরকারি ই-ক্রয় কার্যক্রমে প্রতিযোগিতা বাড়াতে করণীয় নিয়ে প্রস্তাব দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। গবেষণায় ই-জিপি পোর্টালে থাকা ২০১২-২০২৩ সালের ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত প্রাপ্ত সব ই-কার্যাদেশ (৪ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩৩টি) বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারি ই-ক্রয়কার্যের ৯৬ ভাগের বেশি কেনাকাটা হয় দুটি পদ্ধতিতে।
এর একটি উম্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি, অন্যটি সীমিত দরপত্র পদ্ধতি। উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ৫৩ ভাগ এবং ৪৩ ভাগ হয়েছে সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে। ই-ক্রয়কার্যে শীর্ষে স্থানীয় সরকার বিভাগ (মোট কার্যাদেশের ৪৪ শতাংশ এবং চুক্তি মূল্যের ৪১ শতাংশ)। যা ই-কেনাকাটার ৯৩ শতাংশ (মোট কার্যাদেশ) আর মূল্যের দিক থেকে ৯৭ শতাংশ।
এসব মূলত ১০টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ই-জিপি সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ায় দরপত্র পড়ার হার আপাতদৃষ্টিতে বাড়ালেও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র জমার গড় মাত্র ৩ দশমিক ৫৩ ভাগ। যেখানে সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে এই গড় ৪৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ডেটা বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে ১০ শতাংশের মূল্যসীমা সীমিত দরপত্র পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। যেখানে কাজ পেতে পূর্ব অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয় না।
যা বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ বিনষ্ট করছে। বিশ্লেষণ বলছে, ই-ক্রয় কার্যক্রমে ৪৬ ভাগ ক্ষেত্রে দরপত্র পড়ে ৪টির কম। উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে এ হার ৬৫ ভাগ, যা ক্রয় প্রক্রিয়ায় কম মাত্রার প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত করে। শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদারের কাজের হিস্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। গড়ে ২৬ ভাগের বেশি কাজ পাচ্ছে এসব বড় ঠিকাদার। নিচের দিকের ১০ শতাংশ ঠিকাদার পাচ্ছে মাত্র ২ থেকে ৩ ভাগ কাজ।
সীমিত দরপত্র পদ্ধতি উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। সার্বিকভাবে, ১৯ শতাংশ ক্ষেত্রে দরপত্র পড়েছে মাত্র একটি। অর্থাৎ প্রতি পাঁচটি দরপত্রের একটি একক দরপত্রের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে এই হার ২৬ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি চারটির একটিই একক দরপত্র।
সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে এই হার মাত্র ১১ শতাংশ। গবেষণা প্রতিবেদনে কাজের ভিত্তিতে একক দরপত্রপ্রবণ শীর্ষ ১০টি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের তালিকাও দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নোয়াখালী সদর উপজেলার প্রকৌশল অফিস, হবিগঞ্জের বিপিডিবির বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ-৫, সোনাইমুড়ী পৌরসভা; চট্টগ্রামের বিপিডিবির বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ-৫, মাধবদী পৌরসভা, গৌরনদী পৌরসভা, ফেনীর পৌরসভা বিভাগ, সিলেটের বিপিডিবির বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ-৫ এবং সিলেটের বিপিডিবির বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ-৩।
একইভাবে টাকার অঙ্কে একক দরপত্রে কাজ পাওয়া শীর্ষ ঠিকাদার হলো ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, নাভানা লিমিটেড, মেসার্স আহসান এন্টারপ্রাইজ, ক্রিয়েটিভ ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড, র‌্যাংগস লিমিটেড, মেসার্স এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ফন ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স বকলি এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ভূঁইয়া বিল্ডার্স ও মেসার্স তেলিখালী কনস্ট্রাকশন।
গবেষণায় এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক কারা, তা বলা হয়নি। ফেনী ও নোয়াখালী সবচেয়ে বেশি একক দরপত্রপ্রবণ জেলা, এই দুই জেলায় প্রতি ২টি কার্যাদেশের একটি একক দরপত্র। এরপরই রয়েছে কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ, এই দুই জেলায় প্রতি তিনটির একটি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে একক দরপত্রের মাধ্যমে। এই তালিকায় ঢাকা জেলার অবস্থান পঞ্চম।
একক দরপত্র পড়ার হার ২৮ ভাগের বেশি। জেলাগুলোর মধ্যে একক দরপত্র সবচেয়ে কম পড়ে শরীয়তপুরে, প্রায় ৫ ভাগের কম। এরপরই রয়েছে  ঠাকুরগাঁওয়ের অবস্থান ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। সিটি করপোরেশনগুলোতে একক দরপত্র পড়ার হার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ৬২ দশমিক ৭০ শতাংশ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৫৫ দশমিক ২১ শতাংশ, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন ৪২ দশমিক ১৭ শতাংশ, গাজীপুর সিটি করপোরেশন ৩২ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ৩১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বিশ্লেষণের আলোকে ই-জিপিকে যোগসাজশমুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক করার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য টিআইবি ৬টি সুপারিশ উত্থাপন করছে। এগুলো হলো ইজিপির আওতার বাইরে থাকা উচ্চ চুক্তিমূল্যের সব দরপত্র দ্রুততার সঙ্গে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় আনতে হবে। সরকারি ক্রয় প্রতিযোগিতার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি এবং সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে আরোপিত মূল্যসীমা প্রত্যাহার করতে হবে।
সীমিত দরপত্র পদ্ধতি অনুসরণের বর্তমান ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ঢেলে সাজিয়ে সরকারি ক্রয় আইন ২০০৬-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিতে এবং সম্ভাব্য যোগসাজশ বন্ধে একক দরপত্রপ্রবণ ক্রয় অফিসগুলোকে নজরদারির ভেতর আনতে হবে। সব ক্রয় কর্তৃপক্ষ এবং সিপিটিইউ সরকারি ক্রয় প্রতিযোগিতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। উপাত্তনির্ভর বিশ্লেষণ এবং এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে জোরদার করতে হবে।
সারাবেলার সংবাদ/ এমএএইচ/ ২৫ সেপ্টম্বর ২০২৩
Facebook Comments Box