ঢালাও মামলা: দেশে-বিদেশে আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি আ.লীগের
- আপডেট সময় : ০৭:১৭:৫৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ ৬ বার পঠিত
জুলাই- অগাস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে ছাত্র-জনতাকে নির্মমভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা, হত্যার ইন্ধন ও নির্দেশ প্রদানের অভিযোগে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৩৫০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি কয়েক লাখ। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম এসব তথ্য ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান।
তিনি বলেন, “এসব মামলায় এখন পর্যন্ত তৎকালীন সরকারি দলের নেতৃস্থানীয় হাই-প্রোফাইল ১০০ জনসহ ১০ হাজারের অধিক আসামি গ্রেফতার হয়েছে।”
৫ আগস্টের পরে হওয়া অধিকাংশ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের নেতা, পুলিশের সাবেক আইজি, ডিএমপির সাবেক কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা, সাংবাদিকসহ অনেককে আসামি করা হয়েছে।
অথচ এই আসামিদের মধ্যে অনেকে ঘটনার সময় দেশে ছিলেন না, কিংবা কারও কারও অবস্থান ছিল আন্দোলনের পক্ষে। আবার এসব আসামিদের কারও-কারও আন্দোলনের সময়কার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগে আসামি করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতাকে ‘গণহত্যার’ অভিযোগে জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
গত ৫ আগস্ট ঢাকার আদাবরে গার্মেন্টসকর্মী রুবেল হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে ক্রিকেটার ও সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানকে। যদিও সেই সময় এই ক্রিকেটার দেশে ছিলেন না।
আরেক গার্মেন্টসকর্মী হত্যাচেষ্টায় অভিযোগের মামলায় আসামি করা হয় আইনজীবী জেড আই খান পান্নাকে। অথচ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা রাখেন। তাকেই আসামি করা নিয়ে চারদিকে সমালোচনা হলে পরবর্তী সময়ে মামলা থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।
বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, গত চার মাসে সারাদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং দলের নেতাকর্মীদের নামে গণহত্যা, হত্যা, গুম এবং অপহরণের অভিযোগে ৬৮০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৬৩ হাজার ৫৮৩ জনের নামে অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৪৮৭ জনকে।
এভাবে হাজার-হাজার মানুষকে আসামি করে মামলা করার কারণে ভুক্তভোগী পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
তারা বলছেন, একটি মামলায় নাম উল্লেখ করে আসামি করা হচ্ছে ২ থেকে ৩ শতাধিক মানুষকে। আবার অজ্ঞাতনামা কয়েকশ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক আসামির কারণে তদন্তে অনেক সময়ক্ষেপণ হবে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় দেখা দেবে দীর্ঘসূত্রতা। যার ফলে প্রকৃত আসামিরা পার পেয়ে যেতে পারে বলে ধারণা তাদের।
এভাবে ঢালাও মামলা সরকার দিচ্ছে না, কিন্তু তাতে সরকার ‘বিব্রত’ বলে উল্লেখ করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। গত ১২ নভেম্বর ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে আসিফ নজরুল বলেন, “বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গায়েবি মামলা হতো। সরকারের পক্ষ থেকে গায়েবি মামলা দিত। আর এখন আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা দিচ্ছি না।”
সাধারণ লোকজন, ভুক্তভোগী লোকজন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তারা অন্যদের ব্যাপারে ঢালাও মামলা দিচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন আসিফ নজরুল।
এভাবে ‘ঢালাও মামলা’ বিব্রতকর উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, “ঢালাও মামলার একটা খুব মারাত্মক প্রকোপ দেশে দেখা দিয়েছে। এটা আমাদের অত্যন্ত বিব্রত করে।”
৫ ডিসেম্বর পুলিশ সদরদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, “৫ অগাস্টের পরে অনেক ‘মিথ্যা মামলা’ হয়েছে। এসব মামলা নিয়ে ‘বাণিজ্য’ হচ্ছে। তাই মামলায় নাম থাকলেই পাইকারিভাবে গ্রেফতার করা যাবে না।”
ওই সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পরে কেউ যদি ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা মামলা করে থাকেন, তাহলে আইন-বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা বাদীর বিরুদ্ধে নেয়া হবে। পেনাল কোডের ২১১ ধারা অনুযায়ী বিচারের মুখোমুখি হতে হবে সেই বাদীকে।
কেউ যদি মনে করেন দায়েরকৃত মামলাতে তার নিজের কোনো ইন্ধন বা সংশ্লিষ্টতা নেই, তাহলে তাকে সরাসরি পুলিশের কাছে আসার আহবান জানিয়ে আইজিপি বলেন, “আমরা বিনা যুক্তিতে বা তদন্ত ছাড়া পাইকারি হারে গ্রেপ্তার করব না। মামলা থাকলেই বা নাম থাকলেই গ্রেফতার করতে হবে, আইনেও তা নেই। যারা নিরীহ এবং মনে করছেন কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই, হয়রানি করার জন্য মামলায় নাম দেয়া হয়েছে, তারা এগিয়ে আসুন। আমরা আপনাদের বক্তব্য নিয়ে এগিয়ে যাব। চার্জশিট বা ফাইনাল রিপোর্ট দেব। সেখানে নিরীহরা বাদ যাবেন।”
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকজন নেতা ভয়েস অব আমেরিকাকে জানিয়েছেন, তারা এখনও পর্যন্ত আদালতে যেতে পারছেন না। তবে আওয়ামী লীগ দেশে-বিদেশে আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কী বলছেন মানবাধিকার কর্মীরা?
হত্যার ঘটনায় যেসব হত্যা মামলা হয়েছে, তাতে ঘটনাস্থল ও মামলার তারিখ ছাড়া এজাহারসহ সবকিছুই প্রায় অভিন্ন বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, মামলা হচ্ছে ঢাকায় আর আসামি হচ্ছে অন্য জেলার মানুষ। যার কারণে এসব মামলার গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে।
এ ছাড়া বেশির ভাগ আসামির ক্ষেত্রে ‘হুকুমদাতা-নির্দেশদাতা ও ইন্ধনকারী’ উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে এসব মামলা প্রমাণ করে বিচার নিশ্চিত করা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “গণহারে এমন মামলার কারণে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে। এ ধরনের একটা মামলায় ১০০ জন আসামি আছেন। তখন প্রত্যেক আসামির আলাদা তদন্ত হবে। কারণ তদন্ত কর্মকর্তা চাইলে মতামত দিতে পারবেন না, ঘটনায় ওই ব্যক্তি ছিল না। তাকে তদন্ত করে এটা বলতে হবে। আবার দায়সারা তদন্ত করলে তখন সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। এতে দেখা যাবে তদন্ত করতে ৫ বছর লাগছে। তখন অনেক আলামতও নষ্ট হয়ে যাবে।”
“মামলা এক জায়গায় আবার আসামি হয়েছে ভিন্ন জেলার। এতে বিচার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হওয়ার পাশাপাশি সত্যিকারের অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে পার পেয়ে যেতে পারে” মনে করেন এই আইনজীবী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “মামলা আগের মতো গণহারে হচ্ছে। মাঝখানে একটি মামলায় আমাকেও আসামি করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। মেরাদিয়া নামক একটি জায়গার হত্যাচেষ্টা মামলায় আসামি করা হয়েছিল। অথচ মেরাদিয়া কোথায় আমি জানিও না, যাওয়া তো দূরের কথা।”
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান এই আইনজীবী বলেন, “এখন যা হচ্ছে, সবই হত্যা মামলা। অনেক ভিকটিম আমার কাছে আইনি সহায়তার জন্য আসছে। দেখা যাচ্ছে, মামলা হয়েছে ঢাকায় আর আসামিদের মধ্যে ১০ জন বিনাইদহ, ১০ জন বরিশালের। এইভাবে বিভিন্ন জায়গার লোক নিয়ে একটি মামলায় ৩০০ জনকে আসামি করা হচ্ছে।”
“গণহারে আসামি করা এসব হত্যা মামলার তারিখ ও ঘটনার স্থল বাদ দিলে সবকিছুই একই। আসামিরাও প্রায় অভিন্ন” বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, আইনজীবী, খেলোয়াড় ও অভিনেতাদের ঢালাওভাবে হত্যা মামলার আসামি করা প্রসঙ্গে সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, “এটা তো আপনি-আমি সবাই বুঝি। আমি নির্দিষ্ট কারও নাম না নিয়ে, নিজের নামই বললাম। এইভাবে গণহারে হত্যা মামলা ও আসামি করার কারণে মামলাগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
তবে “এসব মামলা আদৌ যে টিকবে না, তা আমি গ্যারান্টি দিতে পারি” বলে যোগ করেন পান্না।
গণহারে আসামি করা প্রসঙ্গে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “আমাদের কাছে কিছু তথ্য এসেছে ‘পুলিশ টাকা খেয়ে’ কাউকে-কাউকে আসামি করছে। আবার কেউ ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে অন্যকে আসামি করছে।”
শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের নামে মামলার তদন্ত এক মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
জুলাই-অগাস্টের গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা দুই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে আগামী ১৮ই ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য নতুন তারিখ নির্ধারণ করেছে আদালত। তবে ৪৬ জনের মধ্যে অধিকাংশ আসামির নাম প্রকাশ করেনি ট্রাইব্যুনাল।
গত ১৮ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া এই আদেশে আর বলা হয়- ৫ অগাস্টের পরে গ্রেফতার সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, ফারুক খান, ডা. দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, জুনাইদ আহমেদ পলক, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সালমান এফ রহমান, সাবেক বিচারপতি এইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব জাহাঙ্গীর আলমসহ ২২ জনকে ট্রাইব্যুনালের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে আটক রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কেন আসামিদের নাম গোপন রাখা হয়েছে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “যে-সব আসামি গ্রেফতার হয়নি, তাদের নাম আমরা জানাচ্ছি না। কারণ নাম প্রকাশ হলে তারা পালিয়ে যেতে পারে, এই কারণে গোপন রাখা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ জন এমপি-মন্ত্রী আর ৮ জন প্রশাসনের (পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী) ট্রাইব্যুনালের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে আটক রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”
চার মাসে ৬৮০ মামলা হত্যা মামলা, নাম উল্লেখ করে আসামি ৬৩ হাজার ৫৮৩ জন
বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অগাস্ট মাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী-এমপি ও দলটির নেতাকর্মীদের নামে ২৬৮টি হত্যাকাণ্ডের মামলা হয়েছে।
এসব মামলায় ২৬ হাজার ২৬৪ জনের নামে অভিযোগ আনা হয়েছে। আর অজ্ঞাতনামা অন্তত ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫৫৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সেপ্টেম্বর মাসে মামলা হয়েছে ২৩৮টি। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করে ১৯ হাজার ২৮৩ জনকে আর অজ্ঞাতনামা ৩০ হাজার ২৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
অক্টোবর মাসে মামলার সংখ্যা কমে এসেছে। এই মাসে মামলা হয়েছে ১০২টি। এতে নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে ১২ হাজার ১৮০ জনকে। আর অজ্ঞাতনামা আসামি ১৫ হাজার ৭৯৯ জন।
আর সর্বশেষ নভেম্বর মাসে মামলার সংখ্যা দুই ডিজিটে নেমে এসেছে। ওই মাসে মামলা হয়েছে ৭৪টি। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করে ৫৮৬৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সংগঠনটির তথ্য মতে, এসব মামলার উল্লেখযোগ্য অভিযোগ হচ্ছে আন্দোলনের সময় নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি ও সরকারি কর্মকর্তারা এতে হুকুমদাতা, অর্থদাতা এবং পরিকল্পনাকারী।
সাবেক মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ নির্বিচারে ও ঢালাওভাবে আসামি করে মামলা দায়ের কোনোভাবে কাম্য নয় বলে উল্লেখ করে বলেন, “এটি অনৈতিক এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। মামলাগুলো বস্তুনিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন।”
“প্রকৃত ঘটনা নিরূপণ করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা এবং নির্দোষ ব্যক্তিকে হয়রানির হাত থেকে মুক্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সকল অংশীজনের দায়িত্ব” বলে যোগ করেন কামাল উদ্দিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সাবেক ডিন তাসলিমা মনসুর ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই। কারণ কে কখন কার পেছনে লাগে, সেটা বলা মুশকিল। তবে ৩০০ জন মানুষকে একটা মামলার আসামি করলে, এটা চলবে নাকি। কারণ এত আসামি ডাকা, তাদের জবানবন্দি নেওয়া সম্ভব? সম্ভব না।”
হত্যা মামলায় গ্রেফতার ৬ সাংবাদিক
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে ১৪০ জন সাংবাদিককে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এভাবে ঢালাওভাবে সাংবাদিকদের হত্যা মামলার আসামি করা নিয়ে নিন্দা জানিয়েছিল সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়কার ‘বিতর্কিত’ ভূমিকার জন্য আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু, শ্যামল দত্ত ও সাংবাদিক দম্পতি শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপা হত্যা মামলায় রিমান্ড শেষে বর্তমানে কারাগারে আছেন।
গত ২২ নভেম্বর রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে প্রায় ১৪০ জন সাংবাদিক ছাত্র-জনতাকে হত্যার অভিযোগে করা ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ মামলার আসামি হয়েছেন। কোনো ধরনের অনুসন্ধান ছাড়াই এসব মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন পাঁচজন সাংবাদিক।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত কমিটি কী বলছে
কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়া এইভাবে সাংবাদিকদের আসামি ও গ্রেফতার নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নিন্দা জানানো হয়। যার প্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।
গত ৭ অক্টোবর গঠিত সেই কমিটির সভাপতি করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের সম্প্রচার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আলতাফ-
উল-আলমকে। গত ২৮ অক্টোবর ওই কমিটি প্রথম বৈঠক করে। তারপর তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গত ১ জুলাই থেকে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলার তথ্য-প্রমাণ চাওয়া হয়।
কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলতাফ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “এখন পর্যন্ত আমরা কয়েকটি মিটিং করেছি। সেখানে হয়রানির অভিযোগ এনে বেশ কয়েকটি আবেদন পেয়েছি। এখন আমরা সেইগুলো নিয়ে কাজ করছি, আসলে সেখানে হয়রানি করার জন্য এই মামলাগুলো হয়েছে কিনা।”
কমিটির পর্যবেক্ষণ কী জানতে চাইলে আলতাফ-উল-আলম বলেন, “আমরা কাজ শুরু করেছি। এখনও পর্যন্ত আমাদের কোনো পর্যবেক্ষণ নেই। এ ছাড়া বিস্তারিত কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।”
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২৭০টি মামলা, ট্রাইব্যুনালে ২ শতাধিক অভিযোগ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত চার মাসে সারাদেশে ২৭০টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে ১০০ এর বেশি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা এমএসএফ তথ্য মতে, শেখ হাসিনার নামে অগাস্ট মাসে মামলা হয়েছে ১০০টি, সেপ্টেম্বরে ১১১টি, অক্টোবরে ৩৪টি ও নভেম্বর মাসে ২৫টি।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১৫ অগাস্ট ঢাকার আদালতে প্রথম মামলা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যা, হত্যার। এ ছাড়া সরকারের গত ১৫ বছরের গুম এবং অপহরণের অভিযোগেও মামলা হয়েছে তার নামে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম বলেন, “ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুই শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। এগুলো প্রাথমিক অভিযোগ। যে যার মতো করে অভিযোগ দিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আমরা কতগুলো অভিযোগ কোর্ট-এ দেব, সেটা দেখার বিষয়।”
আইনি লড়াইয়ে দেশি-আন্তর্জাতিক প্রস্তুতি নিচ্ছে আ.লীগ
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুই শতাধিক মামলা হয়েছে বলে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “তার বিরুদ্ধে প্রতিদিনই মামলা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন থানায় ঢালাওভাবে খুনের মামলা দেওয়া হচ্ছে। এটার শেষ কোথায় আমরা জানি না।”
শেখ হাসিনা ও দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা হত্যা মামলাগুলো আইনিভাবে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। তার জন্য দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে যারা এসব মামলায় সহযোগিতা করতে পারে, তাদের সাহায্য নেবে দলটি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে আইনি মোকাবিলা করার সুযোগ নেই বলে দাবি তাদের।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, “অবশ্যই আমরা এসব মামলা আইনিভাবে মোকাবিলা করব। আমাদের সিনিয়র ও তরুণ আইনজীবীরা চেষ্টা করছেন। তবে এখন আইনি মোকাবিলা করার মতো পরিস্থিতি আদালতে নেই।”
“আইনি লড়াইয়ের জন্য দেশি এবং আন্তর্জাতিক; বহির্বিশ্বে যে-সব আইনজীবী, যারা এসব মামলায় আইনি সহায়তা দিতে পারেন, তাদেরও সহযোগিতা আমরা নেব” বলে জানান নাছিম। ভিওএ