ঢাকা ০৯:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo সোনারগাঁয়ে বাস-অ্যাম্বুলেন্সের সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ১০ Logo সোনারগাঁয়ে ২৫কেজি গাঁজা ও পিকআপ ভ্যানসহ আটক-৩ Logo চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারত-পাকিস্তান মহারণের সূচি প্রকাশ Logo শেষ দুই টেস্টও খেলা হচ্ছে না শামির Logo বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদন্তে ৭ সদস্যের কমিশন গঠন Logo বিয়ের পরিকল্পনা নেই! তবে বাবা হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে! সন্তান প্রসঙ্গে কী মত সলমনের? Logo মস্কোয় অতিষ্ঠ! সিরিয়ার পলাতক প্রেসিডেন্টের থেকে ‘মুক্তি’ চাইছেন স্ত্রী, ফিরে যেতে চান ব্রিটেনে Logo ‘বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ২০০ কোটি রুপি পাওনা রয়েছে ত্রিপুরা’ Logo নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন মত Logo শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের তদন্ত নিয়ে যা জানা যাচ্ছে

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে এখন যে বিষয় এবং প্রশ্ন সামনে আসছে

সারাবেলা প্রতিবেদন
  • আপডেট সময় : ০৮:১৬:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ৬৯ বার পঠিত

দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত তিনটি সরকারের আমলে যে দেশটির সঙ্গে তারা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছে এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে যারা সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, সে দেশটি নি:সন্দেহে ভারত।

প্রধানমন্ত্রী হাসিনার নতুন মেয়াদেও সেই ধারা বজায় থাকার সম্ভাবনা ষোলো আনা।

অন্য দিকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতেও বাংলাদেশের গুরুত্ব বিগত দেড় দশকে ক্রমশ বেড়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবেও ভারত একাধিকবার বলেছে, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশই তাদের ‘সব চেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী’।
এই মন্তব্য করার সময় ভুটানকে হয়তো হিসেবের বাইরে রাখা হয়েছে, কারণ দিল্লি ও থিম্পুর সম্পর্কের রসায়নটা আলাদা – নানা কারণে ভুটানের পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এই সময়কালে নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, কানেক্টিভিটি বা সংযোগ, অভিন্ন নদীগুলোর পানিবন্টন, স্থল ও সমুদ্র সীমায় বিরোধ নিরসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা – ইত্যাদি বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনায় অভাবনীয় অগ্রগতিও লক্ষ্য করা গেছে।
তবে এর মধ্যে সবগুলো ইস্যুরই যে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। সীমান্ত বিরোধ মিটলেও সীমান্তে হত্যা নিয়ে অস্বস্তি যেমন রয়েই গিয়েছে, তেমনি আবার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও তিস্তা চুক্তির জট এখনও খোলা যায়নি।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশে গত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এসেছেন।
ভারতেও সাধারণ নির্বাচন আর মাত্র দু-তিন মাসের মধ্যেই, যাতে পর্যবেক্ষকরা নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপিকেই এগিয়ে রাখছেন।
আর যদি দিল্লিতে ক্ষমতার পালাবদলও হয়, তাহলেও ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকবে বলেই বিশ্লেষকরা নিশ্চিত।

ফলে দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী ও ঢাকায় শেখ হাসিনার সরকার বিগত এক দশকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে ‘টেমপ্লেট’ বা কাঠামোটা গড়ে তুলেছেন, সেটা আরও অন্তত পাঁচ বছর অক্ষুণ্ণ থাকবে বলে ধরেই নেওয়া যায়।

আর এই পটভূমিতেই বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দিল্লিতে এসেছেন বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই বিদেশে তার প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর – যেখানে তিনি বৈঠকে বসবেন তার ভারতীয় কাউন্টারপার্ট এস জয়শঙ্করের সঙ্গে।
তবে টেমপ্লেট অপরিবর্তিত থাকলেও দু’দেশের আলোচনার বিষয়বস্তু বা এজেন্ডাতে পরিবর্তন আসবে সেটাই প্রত্যাশিত – কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনও কোনও ইস্যু হয়তো বেশি গুরুত্ব দাবি করবে, কোনও কোনও বিষয়ে দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছনোর প্রয়োজন হবে।
আগামী পাঁচ বছরে সেই প্রধান ইস্যুগুলো কী কী হতে পারে, তা জানতেই দিল্লিতে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে সাবেক কূটনীতিক, বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্কের বাংলাদেশ ওয়াচার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।
দিল্লি-ঢাকার মধ্যেকার এজেন্ডায় তাদের দৃষ্টিকোণে চারটি বিষয় যেগুলো, এই প্রতিবেদনে তা একে একে তুলে ধরা হল। একইসাথে একটি প্রশ্ন- যা ঘুরপাক খাচ্ছে ভারতীয় বিশ্লেষকদের মনে।
কাম্পালায় ন্যাম বৈঠকের অবকাশে ভারত ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা

গঙ্গা চুক্তির নবায়ন

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে মোট ৫৪টি অভিন্ন নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে গত বেশ কয়েক বছর ধরে যে নদীটির পেছনে দু’দেশেই সবচেয়ে বেশি নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছে, সহজবোধ্য কারণেই সেটি হল তিস্তা।
কিন্তু সেই না-হওয়া তিস্তা চুক্তিকে ছাপিয়ে এখন পরবর্তী অন্তত তিন বছর যে নদীটিকে ঘিরে আলোচনা ঘুরপাক খেতে পারে, সেটি হল গঙ্গা।
তার কারণ, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তির কার্যকাল শেষ হচ্ছে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরেই। ১৯৯৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর যখন দুই দেশ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, তখন সেটির মেয়াদ ধার্য করা হয়েছিল তিরিশ বছর।

ফলে নতুন আকারে চুক্তিটি নবায়ন করার জন্য দিল্লি ও ঢাকার হাতে এখন সময় আছে আড়াই বছরের সামান্য বেশি। এরকম বড় মাপের ও গুরুত্বপূর্ণ একটি জলবন্টন চুক্তির সব দিক খতিয়ে দেখে তা নতুন করে চূড়ান্ত করার জন্য এটা আসলে খুবই অল্প সময়।

বস্তুত ভারত ও বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও যৌথ নদী কমিশনের কর্মকর্তাদের ভেতর গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়ে কথাবার্তা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে বলে বিবিসি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পেরেছে।
ওই কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, নতুন করে যে চুক্তিটি সই হবে, তাতে পানি ভাগাভাগির ফর্মুলা একই থাকবে না কি সেটাতে পরিবর্তন আনা হবে তা নিয়েও শুরু হয়েছে ‘মৃদু দরকষাকষি’।
দিল্লির জেএনইউ-তে সেন্টার ফর সাউথ এশিয়া স্টাডিজের সাবেক প্রধান, অধ্যাপক বলদাস ঘোষাল আবার বলছিলেন গঙ্গা চুক্তির নবায়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে কতটা ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে তা নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “১৯৯৬ সালে ভারতের এইচ ডি দেবেগৌড়া সরকার ও বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে যখন মূল চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তাতে কিন্তু সানন্দ সম্মতি ছিল।”
“অনেকে তো এমনও মনে করেন, রাজ্যের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর উৎসাহেই চুক্তিটি তখন সম্ভব হয়েছিল।”
“কিন্তু এখন তিস্তা চুক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে ভূমিকা আমরা দেখছি, তাতে গঙ্গা চুক্তি নিয়েও তারা কোনও আপত্তি তোলেন কি না সেটাও কিন্তু দেখার বিষয় হবে। হয়তো তারা বলে বসলেন রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়া চুক্তির নবায়ন করাই যাবে না”, বলছিলেন অধ্যাপক ঘোষাল।

বস্তুত গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির সরকার যেভাবে প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তির সম্পাদনে বাধা দিয়ে আসছে, তাতে গঙ্গা চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়েও যে একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

বলদাস ঘোষাল অবশ্য পাশাপাশি এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, রাজনীতিতে আড়াই বছর অনেকটা দীর্ঘ সময়। এর মাঝে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বহু সমীকরণ বদলে যেতেই পারে।
“তা ছাড়া ২০২৬র মে মাসে, অর্থাৎ চুক্তি নবায়নের আগেই পশ্চিমবঙ্গে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা। তাতেও মমতা ব্যানার্জি জেতেন কি না, না কি অন্য কেউ ক্ষমতায় আসেন, বাংলাদেশ নিয়ে তাদের নীতিটা কী হয় – সেটাও দেখতে হবে।”
তবে চুক্তির নবায়নে বাংলাদেশ যে গঙ্গার পানির অধিকতর হিস্যার দাবি জানাবে, এই বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত।
বর্তমান চুক্তিতে বলা হয়েছে, শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার ফারাক্কা পয়েন্টে জলের প্রবাহ যদি ৭০,০০০ কিউসেকের কম হয় তাহলে দুদেশের মধ্যে জল আধাআধি ভাগ হবে।
আর ফারাক্কায় প্রবাহ যদি ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কিউসেকের মধ্যে হয়, তাহলে বাংলাদেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক – আর বাকিটা যাবে ভারতের দিকে।
শুষ্কতম মাস এপ্রিল জুড়েও চুক্তিতে বাংলাদেশকে একটা ন্যূনতম পরিমাণ জল দেওয়ার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে, যদিও বাংলাদেশে একাধিক গবেষক দাবি করেছেন অনেকগুলো এপ্রিলেই চুক্তির সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ বলদাস ঘোষালের কথায়, “তিরিশ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ কিন্তু এক নয়।”

“উন্নয়নের সব দিকে তারা অনেক এগিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে একটা জাতি হিসেবে তাদের মর্যাদাবোধ, অভিমান ও প্রত্যাশাও অনেকে বেড়েছে।”
ফলে নতুন আকারের গঙ্গা চুক্তিতে বাংলাদেশ যে ‘অতিরিক্ত কিছু ফায়দা’র দাবি জানাবে তা নিয়ে তার অন্তত কোনও সন্দেহ নেই।
এখন ভারত তার কতটুকু মানতে রাজি হয়, কোন ফর্মুলায় শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য হয় – তা অবশ্যই আগামী দিনে দেখার বিষয় হবে।
ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়া

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর

বাংলাদেশে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে মাতারবাড়িতে গড়ে তোলা হচ্ছে সে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর বা ডিপ সি পোর্ট। বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে মাতারবাড়ি মাত্র ৩৪ নটিক্যাল মাইল দূরে।
২০২৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে, অর্থাৎ আর মাত্র বছরতিনেকের মধ্যেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এই মুহুর্তে সেখানে কাজ চলছে জোর কদমে।
প্রায় দীর্ঘ দশ বছর ধরে প্রধানত জাপানের ঋণে ২৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করে এই মাতারবাড়ি প্রকল্পটি গড়ে তোলা হচ্ছে।

জাপান এখানে প্রধান সহযোগী দেশ হলেও মাতারবাড়িতে ভারতেরও বিরাট ‘স্টেক’ আছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। ভারতও নানা কারণে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরটি চালু হওয়ার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে দিন গুনছে।

দিল্লিতে বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, বাংলাদেশের সোনাদিয়াতে গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ার ব্যাপারে চীন অত্যন্ত উৎসাহী হলেও বাংলাদেশ সরকার যে শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব নাকচ করে জাপানের পেশ করা মাতারবাড়ি প্রকল্পেই সায় দিয়েছে, তার নেপথ্যে ভারতের একটা বড় ভূমিকা ছিল।
ভারত ও জাপান ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশ হিসেবেই পরিচিত এবং উভয়েই ‘কোয়াড’ জোটের শরিক। আর ভারতও নির্মীয়মান মাতারবাড়িকে তাদের ‘ল্যান্ডলকড’ (স্থলবেষ্টিত) উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য বঙ্গোপসাগরের ‘গেটওয়ে’ বা প্রবেশপথ হিসেবেই দেখছে।
দিল্লিতে কানেক্টিভিটি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ প্রবীর দে-র কথায়, “বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, পায়রা বা মংলা-র মতো বন্দরগুলোতে বহুদিনই আর খুব বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। ফলে মাতারবাড়িই হল সে দেশে সামুদ্রিক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ!”
চট্টগ্রাম বন্দর যে কর্ণফুলী নদীর মোহনায়, সেই নদীমুখে পলি পড়ে বহুদিনই বড় জাহাজ ঢোকার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ভারতের মিজোরামে কর্ণফুলী নদীর যেখানে উৎস, প্রায় শুকিয়ে গেছে সেই উৎসমুখও।
ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে মাল খালাস করতে গেলে বড় জাহাজগুলোকে (মাদার ভেসেল) উপকূল থেকে অনেক দূরে নোঙর করতে হয়, সেখান থেকে ছোট ভেসেলে পণ্য নিয়ে আসতে হয়। স্বভাবতই খরচও তাতে অনেক বেশি পড়ে।
“মাতারবাড়িতে এই সমস্যাটা থাকবে না, কারণ সমুদ্র সেখানে অনেক গভীর এবং ৫০ হাজার টনেরও বেশি পণ্যবাহী কনটেইনারও সেখানে অনায়াসে ভিড়তে পারবে”, বলছিলেন প্রবীর দে।

এই মাতারবাড়ি থেকে সড়কপথে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারেরও কম।

সীমান্তে সাব্রুম শহরে আধুনিক ও বিশাল ‘ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট’ (আইসিপি) প্রায় তৈরি, সীমান্তের মৈত্রী সেতুও প্রস্তুত এবং সাব্রুম থেকে রাজধানী আগরতলা হয়ে বাকি ভারতের রেল সংযোগও চালু।
প্রবীর দে আরও জানাচ্ছেন, “ফলে মাতারবাড়ি ডিপ সি পোর্ট-কে বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি ‘গেমচেঞ্জার’ বলে মনে করার যথেষ্ঠ কারণ আছে। এমন কী চট্টগ্রামও যে সুবিধাটা ভারতের নর্থ-ইস্টকে দিতে পারেনি, সেটাও মাতারবাড়ি দিতে পারবে।”
“আর শুধু তো বন্দর নয়, মাতারবাড়িকে ঘিরে স্পেশাল ইকোনমিক জোন, টাউনশিপ বা আধুনিক উপনগরী, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র – এইসব গড়ে তোলার একটা বিশাল আয়োজন চলছে।”
তাই বাংলাদেশের মঙ্গে ত্রিপুরা রুট দিয়ে ভারতের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দিয়ে আগামী দিনে মাতারবাড়িই হয়তো হয়ে উঠবে প্রধান ‘বাণিজ্যিক হাব’।
আর ঠিক সে কারণেই পরবর্তী পাঁচ বছরে ভারত ও বাংলাদেশের যাবতীয় দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এই প্রকল্পটি ঘুরেফিরে আসবে, তা বলাই বাহুল্য।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করার জন্য ভারতকে অনুমতি দিয়ে রেখেছে। মাতারবাড়ির ক্ষেত্রেও তার কোনও ব্যতিক্রম হবে না, এটাও দিল্লি একরকম ধরেই রেখেছে।
শুকিয়ে যাওয়া পদ্মার বুকে মাছ ধরা নৌকার সারি

অর্থনৈতিক সহযোগিতা

বাংলাদেশের অর্থনীতি এই মুহুর্তে যে একটা সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সে কথা সুবিদিত। সেই সংকটের গভীরতা কতটা, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে।

একদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন হু হু করে কমছে, তেমনি দেশের ভেতরে ডলারের বাজারেও চলছে হাহাকার।
তার ওপর চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বিভিন্ন মেগা-ইনফ্রা প্রকল্পে নেওয়া ঋণের অঙ্ক শোধ করার পালা শুরু হবে, সেটাও বাংলাদেশ কতটা মসৃণভাবে সামলাতে পারবে তা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই সন্দিহান।
এই পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা তার নতুন সরকারে এমন একজনকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছেন, যিনি আগে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের পদ সামলেছেন।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে এ এইচ মাহমুদ আলীকে নিয়োগ করায় ধারণা করা হচ্ছে, ‘ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি’ বা অর্থনৈতিক কূটনীতি বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের কাছে খুবই গুরুত্ব পাবে।
বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণদাতা দেশ বা নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সরকারকে এখন জটিল আলোচনা ও দেনদরবার চালাতে হবে, এমনটাই অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
সম্ভবত এ কারণেই একজন পোড়খাওয়া কূটনীতিবিদকে অর্থমন্ত্রীর ভূমিকায় আনা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় প্রতিবেশী ভারত কী ধরনের ভূমিকা নেয়, সে দিকেও স্বভাবতই পর্যবেক্ষকদের নজর থাকবে। ভারত বাংলাদেশকে ইতিমধ্যেই বেশ বড় অঙ্কের ‘লাইন অব ক্রেডিট’ বা সোজা কথায় ‘ঋণ’ দিয়েছে, সেটাও অবশ্য বজায় থাকবে। এই ঋণের সিংহভাগই এখনো ছাড় হয়নি।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব (ইকোনমিক রিলেশনস) তথা ঢাকায় ভারতের প্রাক্তন হাই কমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী অবশ্য মনে করেন বাংলাদেশে এমন কোনও গভীর সংকট নেই যে ভারতকে তাদের ‘বেইল আউট’ করার কোনও দরকার হবে।

পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “প্রথম কথা হল বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা নয়!”

“হ্যাঁ, কোভিড মহামারি বা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ভারত দেখছে না।”

“ফলে শ্রীলঙ্কাকে যেভাবে আর্থিক অনুদান বা খাদ্য-জ্বালানি-রসদ পাঠিয়ে সাহায্য করতে হয়েছিল, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার কোনও দরকার হবে বলে ভারত এখনও মনে করে না”, জানাচ্ছেন তিনি।
তবে শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করতে ভারত অন্য যে সব পদক্ষেপ নিয়েছিল, যেমন আইএমএফ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কথা বলে সে দেশের ঋণ পরিশোধের ক্যালেন্ডার ‘রিশিডিউল’ করা, সেগুলো বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও নেওয়া হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর কথায়, “আইএমএফ বা ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, এডিবি-র মতো সংস্থায় ভারতের প্রভাব খুবই বেশি। ফলে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের জন্য বাড়তি সময় দরকার হলে ভারত সেটায় অবশ্যই সাহায্য করবে বলে মনে করি।”

তবে বাংলাদেশের নতুন সরকারকেও সে দেশের বিশাল আকারের মেগা-ইনফ্রা প্রকল্পগুলোতে এবার রাশ টানতে হবে বলে তার ধারণা। ফলে আগামী পাঁচ বছরে অন্তত পদ্মা সেতু বা ঢাকা মেট্রো রেলের মতো নতুন কোনও প্রকল্প সে দেশে দিনের আলো দেখবে, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ।

এর পাশাপাশি ২০২৬ সালেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের কাতার থেকে ‘গ্র্যাজুয়েট’ করে পরের ধাপে উন্নীত হবে – সেই সঙ্গেই হারাবে কোটা-সহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুবিধা।
পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলছিলেন, “তখন কিন্তু ডাব্লিউ টি ও-র নিয়ম অনুযায়ী চাইলেও ভারত বাংলাদেশি পণ্যর জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিতে পারবে না। সেই জন্যই এই মুহুর্তে ‘সেপা’ নামে যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।”
‘কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট’ বা সেপা নামে এই বাণিজ্য চুক্তিটি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই, যদিও তা নানা কারণে এখনও চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছতে পারেনি।
এরই মধ্যে খবর এসেছে, বাংলাদেশ চীন-সমর্থিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জোট আরসেপ-এও যোগ দেওয়ার কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে – যাতে ভারত কিছুটা বিচলিত বোধ করছে বলেও ইঙ্গিত মিলেছে।
“কারণ আমরা যদি বাংলাদেশের সঙ্গে একটি অবাধ বাণিজ্য চুক্তি করি, তাহলে তৃতীয় কোনও দেশের পণ্য যাতে বাংলাদেশ ঘুরে ভারতের বাজার ছেয়ে ফেলতে না-পারে সে দিকেও ভারতকে সতর্ক থাকতে হবে”, বলছিলেন

পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী।

ফলে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা যে আগামী দিনে দুই দেশের এজেন্ডায় খুব বড় একটা অংশ জুড়ে থাকবে তাতে কোনও সন্দেহই নেই!

মাতারবাড়ি প্রকল্পের কাজ চলছে খুব দ্রুত গতিতে

এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম

যে জটিল সমস্যা বা কঠিন পরিস্থিতির কথা সবাই জানে, অথচ চট করে বা প্রকাশ্যে সেটা নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না – সেই অবস্থাটা বোঝাতে ইংরেজিতে ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ – এই ফ্রেজ বা শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেও এরকমই একটা ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ আছে। এবং সেটা আর কিছুই নয় – চীন ফ্যাক্টর।
বস্তুত ঘরের পাশে বাংলাদেশে চীন কতটা আর কীভাবে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে, অথবা বেইজিং কীভাবে ঢাকাকে কাছে টানার চেষ্টা করছে সে দিকে ভারত সব সময় সতর্ক নজর রাখে। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে প্রকাশ্যে কখনোই মন্তব্য করা হয় না।
উল্টোদিকে বাংলাদেশও প্রকাশ্যে অন্তত সব সময়ই চীন ও ভারতের মধ্যে একটা ‘ভারসাম্যের কূটনীতি’ বজায় রাখার চেষ্টা করে চলে। কিন্তু ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্কের মধ্যে চীন ফ্যাক্টর কোনওভাবে ছায়াপাত করছে, এটা তারাও স্বীকার করতে চান না।
তবে অতি সম্প্রতি যেভাবে বাংলাদেশে তিস্তা বহুমুখী প্রকল্প নির্মাণে চীনের আগ্রহ থাকলেও তাতে ভারতের আপত্তির কথা প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে আগামী দিনেও ঢাকা-দিল্লির আলোচনায় চীন প্রসঙ্গ বারে বারেই আসবে।
তিস্তার ওপর বাংলাদেশে একটি বহুমুখী ব্যারাজ প্রকল্প নির্মাণে তাদের আগ্রহের কথা চীনা রাষ্ট্রদূত ঘোষণা করেছিলেন প্রকাশ্যেই।

গত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের ঠিক পর পরই চীন এই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চাইলেও ভারত বাদ সেধেছে বলেই সে প্রক্রিয়া আপাতত থমকে আছে।

ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ঘনিষ্ঠ ফরেন পলিসি এক্সপার্ট শুভ্রকমল দত্তর কথায়, “বাংলাদেশকে যে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেই চলতে হবে এটা ভারত খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করে। চীনের মুখের ওপর সব দরজা বন্ধ করতে দিতে হবে, এ কথা কেউ বলছেও না।”
“কিন্তু বাংলাদেশে যদি চীন এমন কিছু করতে যায় যেটা ভারতের স্ট্র্যাটেজিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থকে সরাসরি হুমকিতে ফেলবে, ভারত অবশ্যই সেটা অ্যাড্রেস করতে চাইবে”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বস্তুত চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগীও বটে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন থেকেই, ভারতের তুলনায় যে পরিমাণ অন্তত আড়াই গুণ।
প্রতিরক্ষা খাতেও বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সামরিক সরঞ্জাম কেনে চীনের কাছ থেকেই।
বছরকয়েক আগে বাংলাদেশ নৌবাহিনী চীনের কাছ থেকে দুটি ডুবোজাহাজ বা সাবমেরিনও পেয়েছিল, যা ভারতকে তখন বেশ বিচলিত করে।
সে সময় ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিক্কর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন।

মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে (যাতে ভারতও আছে) বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে অতি সম্প্রতিও আন্তর্জাতিক স্তরে কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা গেছে।

অন্য দিকে বাংলাদেশ ‘কোয়াড’ জোটে ভিড়লে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হবে, প্রকাশ্যেই এ ধরনের প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি এসেছে চীনের কাছ থেকে।

এই পরিস্থিতিতে তথাকথিত ‘চীন ফ্যাক্টর’ যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে আগামীতে আরও প্রবলভাবে ছায়াপাত করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শুভ্রকমল দত্ত মনে করছেন, এখানে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
প্রথমত মালদ্বীপের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলছেন, সম্প্রতি ভারত মহাসাগরের ওই দ্বীপপুঞ্জে যেভাবে ভারত-বিরোধী সেন্টিমেন্টে ভর করে একটি চীন-পন্থী সরকার ক্ষমতায় এসেছে ভারত কিছুতেই চাইবে না বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি হোক।
ফলে বাংলাদেশের মাটিতে চীনের রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক প্রভাব খর্ব করার একটা চেষ্টা ভারতের দিক থেকে থাকবেই।
দ্বিতীয়ত, ভারত এটা বিশ্বাস করে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুতেই বাংলাদেশের ভূখন্ডকে ভারত-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করতে দেবেন না। ফলে চীন যতই চেষ্টা করুক, বাংলাদেশকে তারা ভারতের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারবে না।

শুভ্রকমল দত্ত এটাও জানাচ্ছেন, তার সদ্যগঠিত মন্ত্রিসভায় শেখ হাসিনা ‘প্রচ্ছন্নভাবে চীনপন্থী’ কয়েকজন হেভিওয়েট নেতাকে বাদ দিয়েছেন বলেই ভারত মনে করে – যে পদক্ষেপকে তারা অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে।

তৃতীয়ত, দেশটা যখন বাংলাদেশ – তখন সেখানে চীনের তুলনায় ভারতের সব সময় একটা ‘সাংস্কৃতিক অ্যাডভান্টেজ’ থাকবে বলেই ড. দত্তর ধারণা।

“আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক শুধু ঐতিহাসিকই নয়, এই দুই দেশের পিপল-টু-পিপল কনট্যাক্ট বা মানুষে মানুষে আদানপ্রদানও অনেক বেশি জোরালো। চীন সেটা কখনোই গড়ে তুলতে পারবে না, আর এখানে ভারত চিরকাল অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে”, আত্মবিশ্বাসী সুরে জানাচ্ছেন শুভ্রকমল দত্ত।
গত মাসে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত তার পরিবারের সদস্যরা

শেখ হাসিনার পর কে?

এই তালিকার পাঁচ নম্বর বা শেষ এন্ট্রি-টি এমন একটি ইস্যু, যা নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনার টেবিলে দুদেশের মধ্যে কখনোই কথাবার্তা হয় না। কিন্তু সম্প্রতি এই প্রশ্নটাকে ঘিরে অনানুষ্ঠানিক ও ঘরোয়া আলোচনায় জল্পনা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
আর সেই ইস্যুটা হল – শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হবেন কে বা কারা?
৯৪৭ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করা শেখ হাসিনার বয়স এখন ৭৬-র ওপরে। পাঁচ বছর বাদে যখন বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা, তখন তার বয়স একাশি পেরিয়ে যাবে।

কিন্তু তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ালে বা তার অবর্তমানে আওয়ামী লীগের হাল কে ধরবেন, সেটা নিয়ে শেখ হাসিনা এখনও স্পষ্ট কোনও ইঙ্গিত দেননি। এই বিষয়টা ভারতকে ইদানীং সামান্য অস্বস্তিতে রেখেছে।

ভারতের একজন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বিবিসিকে বলেছেন, “বিগত প্রায় তিন দশক ধরে ভারত বাংলাদেশে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের ওপরই রাজনৈতিক বাজি ধরে আসছে, বা অন্যভাবে বললে ‘ইনভেস্ট’ করে আসছে।”
“কিন্তু শেখ হাসিনার পরে কে, বা আওয়ামী লীগে কার ওপর আমরা ভরসা রাখব সেটাও এখন আস্তে আস্তে জানা দরকার।”
বিষয়টা যতদিন না স্পষ্ট করা হচ্ছে, ততদিন ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভেতরে একটা ‘অস্বস্তি’, ‘অনিশ্চয়তা’ বা ‘অধৈর্য ভাব’ কাজ করবে বলেও সাবেক ওই কূটনীতিবিদের বিশ্বাস।
ভারতে ওপি জিন্দাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ‘বাংলাদেশ অন আ নিউ জার্নি’ বইয়ের লেখক শ্রীরাধা দত্তও মানেন, দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পরিসরে এটাকে একটা ‘ট্যাবু’ বা প্রায় নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়।
“তার কারণ ভারত বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যখনই কোনও বড় নেতা-নেত্রীর ‘সাকসেসন প্ল্যান’ বা উত্তরাধিকার নিয়ে কথা বলা হয়, তখনই অনেকে ধরে নেন এতে বোধহয় তাকে সরে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করা হচ্ছে”, বলছিলেন ড. দত্ত।

কিন্তু সেই ভাবনাকে দূরে সরিয়ে রাখলেও শেখ হাসিনাকে এখন আস্তে আস্তে এই বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিতেই হবে বলে তার ধারণা।

“বর্তমান মেয়াদের প্রথম আড়াই তিন বছর এটা নিয়ে হয়তো বিশেষ নড়াচড়া হবে না। কারণ ওই সময়কালটা খুব ‘ক্রিটিকাল’, ওইটুকু পথ পেরিয়ে যেতে পারলে সরকারের পুরো মেয়াদ শেষ করা নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন উঠবে না।”
সেই উত্তরাধিকারী কে হবেন তা এখনই হয়তো বলা সম্ভব নয়, কিন্তু শেখ মুজিবের পরিবারের মধ্যে থেকেই যে কেউ সেই দায়িত্ব পাবেন এটা মোটামুটি নিশ্চিত।
“ভারতও সেই সম্ভাবনাটা ধরেই এগোচ্ছে এবং পরিবারের মধ্যে থেকে কেউ উত্তরাধিকারী হলে তাদের যে কোনও সমস্যা নেই সেটাও অনেক আগেই বুঝিয়ে দিয়েছে”, বলছিলেন শ্রীরাধা দত্ত।
শেখ হাসিনার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তার বোন শেখ রেহানা, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম নিয়েই সবচেয়ে বেশি নাড়াচাড়া হয়ে থাকে।
এছাড়া শেখ রেহানার ছেলে রেদোয়ান ববি সিদ্দিককেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রায়সময়ই দেখা যায়।

ঘটনাচক্রে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল গত সপ্তাহেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) নির্বাচিত আঞ্চলিক অধিকর্তার পদে তার কার্যভার গ্রহণ করেছেন।

নেপালের দক্ষ ও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে এই পদে সাইমা ওয়াজেদের নির্বাচনে ভারতের একটা বড় ভূমিকা ছিল মনে করা হয়।
তা ছাড়া হু-র এই আঞ্চলিক অধিকর্তার কার্যালয়ও দিল্লিতে অবস্থিত, ফলে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এখন অনেকটা সময় দিল্লিতেই কাটাবেন। ভারতের নেতা-মন্ত্রী ও নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গেও তার অনেক বেশি মেলামেশা ও ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হবে।
নিজের মেয়েকে যেভাবে শেখ হাসিনা এই গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক দায়িত্বে নিয়ে এলেন, তাতে ভারতীয় অনেক পর্যবেক্ষকেরই ধারণা তিনি সম্ভবত সায়মা ওয়াজেদকেই নিজের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করতে চাইছেন।
সেই জল্পনা সত্যি হবে কি না তা নিশ্চিতভাবে জানার জন্য অবশ্যই আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু ততদিন পর্যন্ত দিল্লি ও ঢাকার আলোচনার সরকারি এজেন্ডাতে না-হোক, ঘরোয়া ও খোলামেলা কথাবার্তায় প্রসঙ্গটা রেখাপাত করবে অবধারিতভাবে।
Facebook Comments Box
ট্যাগস :

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে এখন যে বিষয় এবং প্রশ্ন সামনে আসছে

আপডেট সময় : ০৮:১৬:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত তিনটি সরকারের আমলে যে দেশটির সঙ্গে তারা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছে এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে যারা সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, সে দেশটি নি:সন্দেহে ভারত।

প্রধানমন্ত্রী হাসিনার নতুন মেয়াদেও সেই ধারা বজায় থাকার সম্ভাবনা ষোলো আনা।

অন্য দিকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতেও বাংলাদেশের গুরুত্ব বিগত দেড় দশকে ক্রমশ বেড়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবেও ভারত একাধিকবার বলেছে, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশই তাদের ‘সব চেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী’।
এই মন্তব্য করার সময় ভুটানকে হয়তো হিসেবের বাইরে রাখা হয়েছে, কারণ দিল্লি ও থিম্পুর সম্পর্কের রসায়নটা আলাদা – নানা কারণে ভুটানের পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এই সময়কালে নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, কানেক্টিভিটি বা সংযোগ, অভিন্ন নদীগুলোর পানিবন্টন, স্থল ও সমুদ্র সীমায় বিরোধ নিরসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা – ইত্যাদি বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনায় অভাবনীয় অগ্রগতিও লক্ষ্য করা গেছে।
তবে এর মধ্যে সবগুলো ইস্যুরই যে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। সীমান্ত বিরোধ মিটলেও সীমান্তে হত্যা নিয়ে অস্বস্তি যেমন রয়েই গিয়েছে, তেমনি আবার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও তিস্তা চুক্তির জট এখনও খোলা যায়নি।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশে গত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এসেছেন।
ভারতেও সাধারণ নির্বাচন আর মাত্র দু-তিন মাসের মধ্যেই, যাতে পর্যবেক্ষকরা নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপিকেই এগিয়ে রাখছেন।
আর যদি দিল্লিতে ক্ষমতার পালাবদলও হয়, তাহলেও ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকবে বলেই বিশ্লেষকরা নিশ্চিত।

ফলে দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী ও ঢাকায় শেখ হাসিনার সরকার বিগত এক দশকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে ‘টেমপ্লেট’ বা কাঠামোটা গড়ে তুলেছেন, সেটা আরও অন্তত পাঁচ বছর অক্ষুণ্ণ থাকবে বলে ধরেই নেওয়া যায়।

আর এই পটভূমিতেই বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দিল্লিতে এসেছেন বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই বিদেশে তার প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর – যেখানে তিনি বৈঠকে বসবেন তার ভারতীয় কাউন্টারপার্ট এস জয়শঙ্করের সঙ্গে।
তবে টেমপ্লেট অপরিবর্তিত থাকলেও দু’দেশের আলোচনার বিষয়বস্তু বা এজেন্ডাতে পরিবর্তন আসবে সেটাই প্রত্যাশিত – কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনও কোনও ইস্যু হয়তো বেশি গুরুত্ব দাবি করবে, কোনও কোনও বিষয়ে দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছনোর প্রয়োজন হবে।
আগামী পাঁচ বছরে সেই প্রধান ইস্যুগুলো কী কী হতে পারে, তা জানতেই দিল্লিতে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে সাবেক কূটনীতিক, বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্কের বাংলাদেশ ওয়াচার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।
দিল্লি-ঢাকার মধ্যেকার এজেন্ডায় তাদের দৃষ্টিকোণে চারটি বিষয় যেগুলো, এই প্রতিবেদনে তা একে একে তুলে ধরা হল। একইসাথে একটি প্রশ্ন- যা ঘুরপাক খাচ্ছে ভারতীয় বিশ্লেষকদের মনে।
কাম্পালায় ন্যাম বৈঠকের অবকাশে ভারত ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা

গঙ্গা চুক্তির নবায়ন

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে মোট ৫৪টি অভিন্ন নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে গত বেশ কয়েক বছর ধরে যে নদীটির পেছনে দু’দেশেই সবচেয়ে বেশি নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছে, সহজবোধ্য কারণেই সেটি হল তিস্তা।
কিন্তু সেই না-হওয়া তিস্তা চুক্তিকে ছাপিয়ে এখন পরবর্তী অন্তত তিন বছর যে নদীটিকে ঘিরে আলোচনা ঘুরপাক খেতে পারে, সেটি হল গঙ্গা।
তার কারণ, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তির কার্যকাল শেষ হচ্ছে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরেই। ১৯৯৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর যখন দুই দেশ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, তখন সেটির মেয়াদ ধার্য করা হয়েছিল তিরিশ বছর।

ফলে নতুন আকারে চুক্তিটি নবায়ন করার জন্য দিল্লি ও ঢাকার হাতে এখন সময় আছে আড়াই বছরের সামান্য বেশি। এরকম বড় মাপের ও গুরুত্বপূর্ণ একটি জলবন্টন চুক্তির সব দিক খতিয়ে দেখে তা নতুন করে চূড়ান্ত করার জন্য এটা আসলে খুবই অল্প সময়।

বস্তুত ভারত ও বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও যৌথ নদী কমিশনের কর্মকর্তাদের ভেতর গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়ে কথাবার্তা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে বলে বিবিসি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পেরেছে।
ওই কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, নতুন করে যে চুক্তিটি সই হবে, তাতে পানি ভাগাভাগির ফর্মুলা একই থাকবে না কি সেটাতে পরিবর্তন আনা হবে তা নিয়েও শুরু হয়েছে ‘মৃদু দরকষাকষি’।
দিল্লির জেএনইউ-তে সেন্টার ফর সাউথ এশিয়া স্টাডিজের সাবেক প্রধান, অধ্যাপক বলদাস ঘোষাল আবার বলছিলেন গঙ্গা চুক্তির নবায়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে কতটা ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে তা নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “১৯৯৬ সালে ভারতের এইচ ডি দেবেগৌড়া সরকার ও বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে যখন মূল চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তাতে কিন্তু সানন্দ সম্মতি ছিল।”
“অনেকে তো এমনও মনে করেন, রাজ্যের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর উৎসাহেই চুক্তিটি তখন সম্ভব হয়েছিল।”
“কিন্তু এখন তিস্তা চুক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে ভূমিকা আমরা দেখছি, তাতে গঙ্গা চুক্তি নিয়েও তারা কোনও আপত্তি তোলেন কি না সেটাও কিন্তু দেখার বিষয় হবে। হয়তো তারা বলে বসলেন রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়া চুক্তির নবায়ন করাই যাবে না”, বলছিলেন অধ্যাপক ঘোষাল।

বস্তুত গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির সরকার যেভাবে প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তির সম্পাদনে বাধা দিয়ে আসছে, তাতে গঙ্গা চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়েও যে একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

বলদাস ঘোষাল অবশ্য পাশাপাশি এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, রাজনীতিতে আড়াই বছর অনেকটা দীর্ঘ সময়। এর মাঝে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বহু সমীকরণ বদলে যেতেই পারে।
“তা ছাড়া ২০২৬র মে মাসে, অর্থাৎ চুক্তি নবায়নের আগেই পশ্চিমবঙ্গে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা। তাতেও মমতা ব্যানার্জি জেতেন কি না, না কি অন্য কেউ ক্ষমতায় আসেন, বাংলাদেশ নিয়ে তাদের নীতিটা কী হয় – সেটাও দেখতে হবে।”
তবে চুক্তির নবায়নে বাংলাদেশ যে গঙ্গার পানির অধিকতর হিস্যার দাবি জানাবে, এই বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত।
বর্তমান চুক্তিতে বলা হয়েছে, শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার ফারাক্কা পয়েন্টে জলের প্রবাহ যদি ৭০,০০০ কিউসেকের কম হয় তাহলে দুদেশের মধ্যে জল আধাআধি ভাগ হবে।
আর ফারাক্কায় প্রবাহ যদি ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কিউসেকের মধ্যে হয়, তাহলে বাংলাদেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক – আর বাকিটা যাবে ভারতের দিকে।
শুষ্কতম মাস এপ্রিল জুড়েও চুক্তিতে বাংলাদেশকে একটা ন্যূনতম পরিমাণ জল দেওয়ার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে, যদিও বাংলাদেশে একাধিক গবেষক দাবি করেছেন অনেকগুলো এপ্রিলেই চুক্তির সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ বলদাস ঘোষালের কথায়, “তিরিশ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ কিন্তু এক নয়।”

“উন্নয়নের সব দিকে তারা অনেক এগিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে একটা জাতি হিসেবে তাদের মর্যাদাবোধ, অভিমান ও প্রত্যাশাও অনেকে বেড়েছে।”
ফলে নতুন আকারের গঙ্গা চুক্তিতে বাংলাদেশ যে ‘অতিরিক্ত কিছু ফায়দা’র দাবি জানাবে তা নিয়ে তার অন্তত কোনও সন্দেহ নেই।
এখন ভারত তার কতটুকু মানতে রাজি হয়, কোন ফর্মুলায় শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য হয় – তা অবশ্যই আগামী দিনে দেখার বিষয় হবে।
ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়া

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর

বাংলাদেশে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে মাতারবাড়িতে গড়ে তোলা হচ্ছে সে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর বা ডিপ সি পোর্ট। বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে মাতারবাড়ি মাত্র ৩৪ নটিক্যাল মাইল দূরে।
২০২৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে, অর্থাৎ আর মাত্র বছরতিনেকের মধ্যেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এই মুহুর্তে সেখানে কাজ চলছে জোর কদমে।
প্রায় দীর্ঘ দশ বছর ধরে প্রধানত জাপানের ঋণে ২৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করে এই মাতারবাড়ি প্রকল্পটি গড়ে তোলা হচ্ছে।

জাপান এখানে প্রধান সহযোগী দেশ হলেও মাতারবাড়িতে ভারতেরও বিরাট ‘স্টেক’ আছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। ভারতও নানা কারণে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরটি চালু হওয়ার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে দিন গুনছে।

দিল্লিতে বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, বাংলাদেশের সোনাদিয়াতে গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ার ব্যাপারে চীন অত্যন্ত উৎসাহী হলেও বাংলাদেশ সরকার যে শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব নাকচ করে জাপানের পেশ করা মাতারবাড়ি প্রকল্পেই সায় দিয়েছে, তার নেপথ্যে ভারতের একটা বড় ভূমিকা ছিল।
ভারত ও জাপান ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশ হিসেবেই পরিচিত এবং উভয়েই ‘কোয়াড’ জোটের শরিক। আর ভারতও নির্মীয়মান মাতারবাড়িকে তাদের ‘ল্যান্ডলকড’ (স্থলবেষ্টিত) উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য বঙ্গোপসাগরের ‘গেটওয়ে’ বা প্রবেশপথ হিসেবেই দেখছে।
দিল্লিতে কানেক্টিভিটি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ প্রবীর দে-র কথায়, “বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, পায়রা বা মংলা-র মতো বন্দরগুলোতে বহুদিনই আর খুব বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। ফলে মাতারবাড়িই হল সে দেশে সামুদ্রিক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ!”
চট্টগ্রাম বন্দর যে কর্ণফুলী নদীর মোহনায়, সেই নদীমুখে পলি পড়ে বহুদিনই বড় জাহাজ ঢোকার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ভারতের মিজোরামে কর্ণফুলী নদীর যেখানে উৎস, প্রায় শুকিয়ে গেছে সেই উৎসমুখও।
ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে মাল খালাস করতে গেলে বড় জাহাজগুলোকে (মাদার ভেসেল) উপকূল থেকে অনেক দূরে নোঙর করতে হয়, সেখান থেকে ছোট ভেসেলে পণ্য নিয়ে আসতে হয়। স্বভাবতই খরচও তাতে অনেক বেশি পড়ে।
“মাতারবাড়িতে এই সমস্যাটা থাকবে না, কারণ সমুদ্র সেখানে অনেক গভীর এবং ৫০ হাজার টনেরও বেশি পণ্যবাহী কনটেইনারও সেখানে অনায়াসে ভিড়তে পারবে”, বলছিলেন প্রবীর দে।

এই মাতারবাড়ি থেকে সড়কপথে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারেরও কম।

সীমান্তে সাব্রুম শহরে আধুনিক ও বিশাল ‘ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট’ (আইসিপি) প্রায় তৈরি, সীমান্তের মৈত্রী সেতুও প্রস্তুত এবং সাব্রুম থেকে রাজধানী আগরতলা হয়ে বাকি ভারতের রেল সংযোগও চালু।
প্রবীর দে আরও জানাচ্ছেন, “ফলে মাতারবাড়ি ডিপ সি পোর্ট-কে বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি ‘গেমচেঞ্জার’ বলে মনে করার যথেষ্ঠ কারণ আছে। এমন কী চট্টগ্রামও যে সুবিধাটা ভারতের নর্থ-ইস্টকে দিতে পারেনি, সেটাও মাতারবাড়ি দিতে পারবে।”
“আর শুধু তো বন্দর নয়, মাতারবাড়িকে ঘিরে স্পেশাল ইকোনমিক জোন, টাউনশিপ বা আধুনিক উপনগরী, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র – এইসব গড়ে তোলার একটা বিশাল আয়োজন চলছে।”
তাই বাংলাদেশের মঙ্গে ত্রিপুরা রুট দিয়ে ভারতের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দিয়ে আগামী দিনে মাতারবাড়িই হয়তো হয়ে উঠবে প্রধান ‘বাণিজ্যিক হাব’।
আর ঠিক সে কারণেই পরবর্তী পাঁচ বছরে ভারত ও বাংলাদেশের যাবতীয় দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এই প্রকল্পটি ঘুরেফিরে আসবে, তা বলাই বাহুল্য।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করার জন্য ভারতকে অনুমতি দিয়ে রেখেছে। মাতারবাড়ির ক্ষেত্রেও তার কোনও ব্যতিক্রম হবে না, এটাও দিল্লি একরকম ধরেই রেখেছে।
শুকিয়ে যাওয়া পদ্মার বুকে মাছ ধরা নৌকার সারি

অর্থনৈতিক সহযোগিতা

বাংলাদেশের অর্থনীতি এই মুহুর্তে যে একটা সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সে কথা সুবিদিত। সেই সংকটের গভীরতা কতটা, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে।

একদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন হু হু করে কমছে, তেমনি দেশের ভেতরে ডলারের বাজারেও চলছে হাহাকার।
তার ওপর চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বিভিন্ন মেগা-ইনফ্রা প্রকল্পে নেওয়া ঋণের অঙ্ক শোধ করার পালা শুরু হবে, সেটাও বাংলাদেশ কতটা মসৃণভাবে সামলাতে পারবে তা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই সন্দিহান।
এই পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা তার নতুন সরকারে এমন একজনকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছেন, যিনি আগে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের পদ সামলেছেন।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে এ এইচ মাহমুদ আলীকে নিয়োগ করায় ধারণা করা হচ্ছে, ‘ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি’ বা অর্থনৈতিক কূটনীতি বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের কাছে খুবই গুরুত্ব পাবে।
বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণদাতা দেশ বা নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সরকারকে এখন জটিল আলোচনা ও দেনদরবার চালাতে হবে, এমনটাই অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
সম্ভবত এ কারণেই একজন পোড়খাওয়া কূটনীতিবিদকে অর্থমন্ত্রীর ভূমিকায় আনা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় প্রতিবেশী ভারত কী ধরনের ভূমিকা নেয়, সে দিকেও স্বভাবতই পর্যবেক্ষকদের নজর থাকবে। ভারত বাংলাদেশকে ইতিমধ্যেই বেশ বড় অঙ্কের ‘লাইন অব ক্রেডিট’ বা সোজা কথায় ‘ঋণ’ দিয়েছে, সেটাও অবশ্য বজায় থাকবে। এই ঋণের সিংহভাগই এখনো ছাড় হয়নি।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব (ইকোনমিক রিলেশনস) তথা ঢাকায় ভারতের প্রাক্তন হাই কমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী অবশ্য মনে করেন বাংলাদেশে এমন কোনও গভীর সংকট নেই যে ভারতকে তাদের ‘বেইল আউট’ করার কোনও দরকার হবে।

পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “প্রথম কথা হল বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা নয়!”

“হ্যাঁ, কোভিড মহামারি বা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ভারত দেখছে না।”

“ফলে শ্রীলঙ্কাকে যেভাবে আর্থিক অনুদান বা খাদ্য-জ্বালানি-রসদ পাঠিয়ে সাহায্য করতে হয়েছিল, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার কোনও দরকার হবে বলে ভারত এখনও মনে করে না”, জানাচ্ছেন তিনি।
তবে শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করতে ভারত অন্য যে সব পদক্ষেপ নিয়েছিল, যেমন আইএমএফ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কথা বলে সে দেশের ঋণ পরিশোধের ক্যালেন্ডার ‘রিশিডিউল’ করা, সেগুলো বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও নেওয়া হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর কথায়, “আইএমএফ বা ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, এডিবি-র মতো সংস্থায় ভারতের প্রভাব খুবই বেশি। ফলে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের জন্য বাড়তি সময় দরকার হলে ভারত সেটায় অবশ্যই সাহায্য করবে বলে মনে করি।”

তবে বাংলাদেশের নতুন সরকারকেও সে দেশের বিশাল আকারের মেগা-ইনফ্রা প্রকল্পগুলোতে এবার রাশ টানতে হবে বলে তার ধারণা। ফলে আগামী পাঁচ বছরে অন্তত পদ্মা সেতু বা ঢাকা মেট্রো রেলের মতো নতুন কোনও প্রকল্প সে দেশে দিনের আলো দেখবে, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ।

এর পাশাপাশি ২০২৬ সালেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের কাতার থেকে ‘গ্র্যাজুয়েট’ করে পরের ধাপে উন্নীত হবে – সেই সঙ্গেই হারাবে কোটা-সহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুবিধা।
পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলছিলেন, “তখন কিন্তু ডাব্লিউ টি ও-র নিয়ম অনুযায়ী চাইলেও ভারত বাংলাদেশি পণ্যর জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিতে পারবে না। সেই জন্যই এই মুহুর্তে ‘সেপা’ নামে যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।”
‘কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট’ বা সেপা নামে এই বাণিজ্য চুক্তিটি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই, যদিও তা নানা কারণে এখনও চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছতে পারেনি।
এরই মধ্যে খবর এসেছে, বাংলাদেশ চীন-সমর্থিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জোট আরসেপ-এও যোগ দেওয়ার কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে – যাতে ভারত কিছুটা বিচলিত বোধ করছে বলেও ইঙ্গিত মিলেছে।
“কারণ আমরা যদি বাংলাদেশের সঙ্গে একটি অবাধ বাণিজ্য চুক্তি করি, তাহলে তৃতীয় কোনও দেশের পণ্য যাতে বাংলাদেশ ঘুরে ভারতের বাজার ছেয়ে ফেলতে না-পারে সে দিকেও ভারতকে সতর্ক থাকতে হবে”, বলছিলেন

পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী।

ফলে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা যে আগামী দিনে দুই দেশের এজেন্ডায় খুব বড় একটা অংশ জুড়ে থাকবে তাতে কোনও সন্দেহই নেই!

মাতারবাড়ি প্রকল্পের কাজ চলছে খুব দ্রুত গতিতে

এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম

যে জটিল সমস্যা বা কঠিন পরিস্থিতির কথা সবাই জানে, অথচ চট করে বা প্রকাশ্যে সেটা নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না – সেই অবস্থাটা বোঝাতে ইংরেজিতে ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ – এই ফ্রেজ বা শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেও এরকমই একটা ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ আছে। এবং সেটা আর কিছুই নয় – চীন ফ্যাক্টর।
বস্তুত ঘরের পাশে বাংলাদেশে চীন কতটা আর কীভাবে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে, অথবা বেইজিং কীভাবে ঢাকাকে কাছে টানার চেষ্টা করছে সে দিকে ভারত সব সময় সতর্ক নজর রাখে। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে প্রকাশ্যে কখনোই মন্তব্য করা হয় না।
উল্টোদিকে বাংলাদেশও প্রকাশ্যে অন্তত সব সময়ই চীন ও ভারতের মধ্যে একটা ‘ভারসাম্যের কূটনীতি’ বজায় রাখার চেষ্টা করে চলে। কিন্তু ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্কের মধ্যে চীন ফ্যাক্টর কোনওভাবে ছায়াপাত করছে, এটা তারাও স্বীকার করতে চান না।
তবে অতি সম্প্রতি যেভাবে বাংলাদেশে তিস্তা বহুমুখী প্রকল্প নির্মাণে চীনের আগ্রহ থাকলেও তাতে ভারতের আপত্তির কথা প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে আগামী দিনেও ঢাকা-দিল্লির আলোচনায় চীন প্রসঙ্গ বারে বারেই আসবে।
তিস্তার ওপর বাংলাদেশে একটি বহুমুখী ব্যারাজ প্রকল্প নির্মাণে তাদের আগ্রহের কথা চীনা রাষ্ট্রদূত ঘোষণা করেছিলেন প্রকাশ্যেই।

গত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের ঠিক পর পরই চীন এই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চাইলেও ভারত বাদ সেধেছে বলেই সে প্রক্রিয়া আপাতত থমকে আছে।

ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ঘনিষ্ঠ ফরেন পলিসি এক্সপার্ট শুভ্রকমল দত্তর কথায়, “বাংলাদেশকে যে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেই চলতে হবে এটা ভারত খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করে। চীনের মুখের ওপর সব দরজা বন্ধ করতে দিতে হবে, এ কথা কেউ বলছেও না।”
“কিন্তু বাংলাদেশে যদি চীন এমন কিছু করতে যায় যেটা ভারতের স্ট্র্যাটেজিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থকে সরাসরি হুমকিতে ফেলবে, ভারত অবশ্যই সেটা অ্যাড্রেস করতে চাইবে”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বস্তুত চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগীও বটে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন থেকেই, ভারতের তুলনায় যে পরিমাণ অন্তত আড়াই গুণ।
প্রতিরক্ষা খাতেও বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সামরিক সরঞ্জাম কেনে চীনের কাছ থেকেই।
বছরকয়েক আগে বাংলাদেশ নৌবাহিনী চীনের কাছ থেকে দুটি ডুবোজাহাজ বা সাবমেরিনও পেয়েছিল, যা ভারতকে তখন বেশ বিচলিত করে।
সে সময় ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিক্কর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন।

মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে (যাতে ভারতও আছে) বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে অতি সম্প্রতিও আন্তর্জাতিক স্তরে কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা গেছে।

অন্য দিকে বাংলাদেশ ‘কোয়াড’ জোটে ভিড়লে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হবে, প্রকাশ্যেই এ ধরনের প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি এসেছে চীনের কাছ থেকে।

এই পরিস্থিতিতে তথাকথিত ‘চীন ফ্যাক্টর’ যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে আগামীতে আরও প্রবলভাবে ছায়াপাত করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শুভ্রকমল দত্ত মনে করছেন, এখানে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
প্রথমত মালদ্বীপের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলছেন, সম্প্রতি ভারত মহাসাগরের ওই দ্বীপপুঞ্জে যেভাবে ভারত-বিরোধী সেন্টিমেন্টে ভর করে একটি চীন-পন্থী সরকার ক্ষমতায় এসেছে ভারত কিছুতেই চাইবে না বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি হোক।
ফলে বাংলাদেশের মাটিতে চীনের রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক প্রভাব খর্ব করার একটা চেষ্টা ভারতের দিক থেকে থাকবেই।
দ্বিতীয়ত, ভারত এটা বিশ্বাস করে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুতেই বাংলাদেশের ভূখন্ডকে ভারত-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করতে দেবেন না। ফলে চীন যতই চেষ্টা করুক, বাংলাদেশকে তারা ভারতের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারবে না।

শুভ্রকমল দত্ত এটাও জানাচ্ছেন, তার সদ্যগঠিত মন্ত্রিসভায় শেখ হাসিনা ‘প্রচ্ছন্নভাবে চীনপন্থী’ কয়েকজন হেভিওয়েট নেতাকে বাদ দিয়েছেন বলেই ভারত মনে করে – যে পদক্ষেপকে তারা অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে।

তৃতীয়ত, দেশটা যখন বাংলাদেশ – তখন সেখানে চীনের তুলনায় ভারতের সব সময় একটা ‘সাংস্কৃতিক অ্যাডভান্টেজ’ থাকবে বলেই ড. দত্তর ধারণা।

“আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক শুধু ঐতিহাসিকই নয়, এই দুই দেশের পিপল-টু-পিপল কনট্যাক্ট বা মানুষে মানুষে আদানপ্রদানও অনেক বেশি জোরালো। চীন সেটা কখনোই গড়ে তুলতে পারবে না, আর এখানে ভারত চিরকাল অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে”, আত্মবিশ্বাসী সুরে জানাচ্ছেন শুভ্রকমল দত্ত।
গত মাসে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত তার পরিবারের সদস্যরা

শেখ হাসিনার পর কে?

এই তালিকার পাঁচ নম্বর বা শেষ এন্ট্রি-টি এমন একটি ইস্যু, যা নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনার টেবিলে দুদেশের মধ্যে কখনোই কথাবার্তা হয় না। কিন্তু সম্প্রতি এই প্রশ্নটাকে ঘিরে অনানুষ্ঠানিক ও ঘরোয়া আলোচনায় জল্পনা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
আর সেই ইস্যুটা হল – শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হবেন কে বা কারা?
৯৪৭ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করা শেখ হাসিনার বয়স এখন ৭৬-র ওপরে। পাঁচ বছর বাদে যখন বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা, তখন তার বয়স একাশি পেরিয়ে যাবে।

কিন্তু তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ালে বা তার অবর্তমানে আওয়ামী লীগের হাল কে ধরবেন, সেটা নিয়ে শেখ হাসিনা এখনও স্পষ্ট কোনও ইঙ্গিত দেননি। এই বিষয়টা ভারতকে ইদানীং সামান্য অস্বস্তিতে রেখেছে।

ভারতের একজন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বিবিসিকে বলেছেন, “বিগত প্রায় তিন দশক ধরে ভারত বাংলাদেশে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের ওপরই রাজনৈতিক বাজি ধরে আসছে, বা অন্যভাবে বললে ‘ইনভেস্ট’ করে আসছে।”
“কিন্তু শেখ হাসিনার পরে কে, বা আওয়ামী লীগে কার ওপর আমরা ভরসা রাখব সেটাও এখন আস্তে আস্তে জানা দরকার।”
বিষয়টা যতদিন না স্পষ্ট করা হচ্ছে, ততদিন ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভেতরে একটা ‘অস্বস্তি’, ‘অনিশ্চয়তা’ বা ‘অধৈর্য ভাব’ কাজ করবে বলেও সাবেক ওই কূটনীতিবিদের বিশ্বাস।
ভারতে ওপি জিন্দাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ‘বাংলাদেশ অন আ নিউ জার্নি’ বইয়ের লেখক শ্রীরাধা দত্তও মানেন, দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পরিসরে এটাকে একটা ‘ট্যাবু’ বা প্রায় নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়।
“তার কারণ ভারত বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যখনই কোনও বড় নেতা-নেত্রীর ‘সাকসেসন প্ল্যান’ বা উত্তরাধিকার নিয়ে কথা বলা হয়, তখনই অনেকে ধরে নেন এতে বোধহয় তাকে সরে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করা হচ্ছে”, বলছিলেন ড. দত্ত।

কিন্তু সেই ভাবনাকে দূরে সরিয়ে রাখলেও শেখ হাসিনাকে এখন আস্তে আস্তে এই বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিতেই হবে বলে তার ধারণা।

“বর্তমান মেয়াদের প্রথম আড়াই তিন বছর এটা নিয়ে হয়তো বিশেষ নড়াচড়া হবে না। কারণ ওই সময়কালটা খুব ‘ক্রিটিকাল’, ওইটুকু পথ পেরিয়ে যেতে পারলে সরকারের পুরো মেয়াদ শেষ করা নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন উঠবে না।”
সেই উত্তরাধিকারী কে হবেন তা এখনই হয়তো বলা সম্ভব নয়, কিন্তু শেখ মুজিবের পরিবারের মধ্যে থেকেই যে কেউ সেই দায়িত্ব পাবেন এটা মোটামুটি নিশ্চিত।
“ভারতও সেই সম্ভাবনাটা ধরেই এগোচ্ছে এবং পরিবারের মধ্যে থেকে কেউ উত্তরাধিকারী হলে তাদের যে কোনও সমস্যা নেই সেটাও অনেক আগেই বুঝিয়ে দিয়েছে”, বলছিলেন শ্রীরাধা দত্ত।
শেখ হাসিনার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তার বোন শেখ রেহানা, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম নিয়েই সবচেয়ে বেশি নাড়াচাড়া হয়ে থাকে।
এছাড়া শেখ রেহানার ছেলে রেদোয়ান ববি সিদ্দিককেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রায়সময়ই দেখা যায়।

ঘটনাচক্রে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল গত সপ্তাহেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) নির্বাচিত আঞ্চলিক অধিকর্তার পদে তার কার্যভার গ্রহণ করেছেন।

নেপালের দক্ষ ও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে এই পদে সাইমা ওয়াজেদের নির্বাচনে ভারতের একটা বড় ভূমিকা ছিল মনে করা হয়।
তা ছাড়া হু-র এই আঞ্চলিক অধিকর্তার কার্যালয়ও দিল্লিতে অবস্থিত, ফলে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এখন অনেকটা সময় দিল্লিতেই কাটাবেন। ভারতের নেতা-মন্ত্রী ও নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গেও তার অনেক বেশি মেলামেশা ও ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হবে।
নিজের মেয়েকে যেভাবে শেখ হাসিনা এই গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক দায়িত্বে নিয়ে এলেন, তাতে ভারতীয় অনেক পর্যবেক্ষকেরই ধারণা তিনি সম্ভবত সায়মা ওয়াজেদকেই নিজের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করতে চাইছেন।
সেই জল্পনা সত্যি হবে কি না তা নিশ্চিতভাবে জানার জন্য অবশ্যই আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু ততদিন পর্যন্ত দিল্লি ও ঢাকার আলোচনার সরকারি এজেন্ডাতে না-হোক, ঘরোয়া ও খোলামেলা কথাবার্তায় প্রসঙ্গটা রেখাপাত করবে অবধারিতভাবে।
Facebook Comments Box