জামায়াত ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি
- আপডেট সময় : ০৩:৫৮:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ অগাস্ট ২০২৪ ১৮ বার পঠিত
ঢাকা: অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে এ সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আর এই সিদ্ধান্তের ফলে রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে যখন জল্পনা-কল্পনা চলছে, ঠিক সেই সময় জামায়াত ইস্যুতে বিএনপির প্রকাশ্য বিভক্তি দেখা দিয়েছে। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গত ২৯ জুলাই সন্ধ্যায় গণভবনে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে। আর এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে আইন মন্ত্রণালয়।
জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বিএনপির মধ্যে দুই ধরনের মতামত পাওয়া গেছে। বুধবার (৩১ জুলাই) বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন যে, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হল কি না তাতে তার কিছু যায় আসে না। তিনি উল্টো প্রস্তাব করেন এতদিন কেন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো না?
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্তত দুজন সদস্য বলেছেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এই বক্তব্য দলীয় বক্তব্য নয়। বরং তারা জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করবেন এবং কোনও রাজনৈতিক দলকে এই মুহূর্তে নিষিদ্ধ করা উচিত নয় বলে তারা মন্তব্য করেছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্তত দুজন সদস্য বলেছেন যে, তাদের সাথে লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কথা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনে করেন, এই মুহূর্তে জামায়াতের পাশে বিএনপির দাঁড়ানো উচিত। কারণ এভাবে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করাটা গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার পরিপন্থি। কিন্তু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির অন্য নেতারা মনে করেন যে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হল কি হল না- এ ব্যাপারে তাদের কোনও ভূমিকা রাখা উচিত নয়। এই বিষয়টি সরকার করছে জনগণের দৃষ্টি অন্য খাতে প্রবাহিত করার জন্য।
তারা মনে করেন যে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও জামায়াতের সঙ্গে যৌথ আন্দোলন এবং সম্পর্ক করার সুযোগ রয়েছে। কাজেই প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনও কথা না বলাই ভালো। তারা মনে করেন যে প্রকাশ্যে জামায়াতের পক্ষে অবস্থান নিলে আন্তর্জাতিক মহলে একটি নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে। এতে বিএনপির ইমেজ নষ্ট হবে। কিন্তু বিএনপি জামায়াতপস্থিরা মনে করছেন যে জামায়াতের রাজনীতির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তটি সরকারের রাজনৈতিক স্টান্টবাজি।
সরকার এমন সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যখন শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার কোণঠাসা। এই মুহূর্তে সরকার আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। এই দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই তারা বিভিন্ন ধরনের অপচেষ্টায় লিপ্ত। তার মধ্যে একটি হল জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং এমন এক সময় এ ঘোষণা এসেছে যখন বিএনপি-জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে একদফা দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে।
বিএনপির এই অংশের নেতারা মনে করেন, এই ঘটনা থেকে প্রমাণ হয় সরকার রাজনৈতিক দলের ওপর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চায়। এর প্রতিবাদ সকল রাজনৈতিক দলের করা উচিত। আর এ নিয়ে এখন বিএনপিতে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, গত কিছুদিন ধরেই বিএনপি চলছে লন্ডনে পলাতক দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার একক নির্দেশে। তিনি যেভাবে বলছেন সেভাবে দল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এখানের দলের মহাসচিবের কোনো ভূমিকা নাই। এ অবস্থার কারণে বিএনপি আন্দোলনের ব্যাপারেও স্থির ভাবে কাজ করতে পারছে না। এখন জামায়াত ইস্যুতে বিএনপির দ্বিধাবিভক্তি প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি দীর্ঘদিনের। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার পর সে দাবি আরো জোরালো হলেও গত ১৫ বছরে জোরালো কোনো উদ্যোগ সরকারের তরফে নেওয়া হয়নি।
এবার কোটাবিরোধী আন্দোলনকে সহিংস রূপ দেওয়ার পেছনে বিএনপি ও জামায়াতকে দায়ী করে আসছেন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। তার মধ্যেই আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত এলো।
এক নজরে জামায়াতে ইসলামী
জামায়াতে ইসলামীর সূচনা হয় উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ অগাস্ট, তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।
পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরোধিতা করায় ১৯৬৪ সালে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবির বিরোধিতা করে জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ নামে বিভিন্ন দল গঠন করে জামায়াত ও এর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ।
সে সময় তারা সারা দেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মতো যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। আদালতে ঘোষিত যুদ্ধাপরাধ মামলার বিভিন্ন রায়ে বিষয়গুলো উঠে আসে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, হত্যাকাণ্ডে সায় ও সহযোগিতা দেয়ার দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমকে টানা ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলটির পাঁচ শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে একটি রায়ে বলা হয়, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়।
১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় জামায়াতও এর আওতায় পড়ে। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের সরকার আবার জামায়াতকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেয়। সেই সুযোগে গোলাম আযম ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে দলের আমিরের দায়িত্ব নেন।
সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পায় এবং সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসন কমে তিনটি হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত পায় ১৭ আসন। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভাতেও জায়গা পান জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা।
একাত্তরে ন্যক্কারজনক ভূমিকার পরও খালেদা জিয়ার চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়াকে লাখো শহীদের প্রতি ‘চপেটাঘাত’ হিসেবে বর্ণনা করা হয় যুদ্ধাপরাধের এক মামলার রায়ে।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দুটি আসন পেয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। এরপর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক তরীকত ফেডারেশনের নেতা রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ কয়েকজনের রিট আবেদনে হাই কোর্ট ২০১৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করে। গতবছর সর্বোচ্চ আদালতেও হাই কোর্টের ওই রায় বহাল থাকে।
নিবন্ধন বাতিলের পর জামায়াত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়নি। তবে ২০১৯ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে জোটসঙ্গী বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে ভোটে অংশ নিয়েছিলেন জামায়াতের কয়েকজন। পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে না পারলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জামায়াত নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
দীর্ঘ সময় বিএনপির সঙ্গে থাকা জামায়াত এখন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সঙ্গে জোটে নেই। তবে চলতি বছর জানুয়ারিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির হরতাল অবরোধের সঙ্গে মিল রেখে একই কর্মসূচি দিয়েছে দলটি।
তরীকত ফেডারেশনের নেতা রেজাউল হক চাঁদপুরী জামায়াতে ইসলামীর মিছিল-সমাবেশসহ সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েও ২০২৩ সালে আপিল বিভাগে একটি আবেদন করেছিলেন। এর পর ওই বছরের নভেম্বরে আপিল বিভাগ জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে চূড়ান্ত রায় দিয়ে দিলে ওই রিট মামলা আর এগোয়নি।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্য দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের দাবিও দীর্ঘদিনে। তবে আইনি জটিলতার কারণে সে বিষয়টি আটকে আছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনের অধীনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১৩ সালে আইনে সংশোধনী এনে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আসামির পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষেরও আপিলের সমান সুযোগ তৈরি করা হয়।
ট্রাইব্যুনালে বিচারে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা। তার মধ্যে রয়েছে দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদ, নায়েবে আমির আব্দুস সোবহান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, মো. কামরুজ্জামান, শূরা সদস্য মীর কাসেম আলী।
একাত্তরে জামায়াতের আমিরের দায়িত্বে থাকা গোলাম আযম, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। গোলাম আযম কারাগারেই মারা গেছেন। আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত সাঈদীও কারাগারে মারা গেছেন।
ব্যক্তির অপরাধের বিচার হলেও দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের দাবি ২০১৩ সালেই গণজাগরণ মঞ্চ থেকে তোলা হয়েছিল। গোলাম আযমের মামলার রায়ে আদালত জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করার পর দাবিটি আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগের নেতারাও বিভিন্ন সময়ে এর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে আইনে গঠিত, সেখানে দলের বিচারের সুযোগ না থাকায় বিষয়টি আটকে যায়।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২০২২ সালের আগস্টে বলেছিলেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্য দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারে আইন সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদের পাঠানো হয়েছে। কিন্তু পরে সে বিষয়টি আর সংসদ পর্যন্ত যায়নি।