চাঁদের রহস্যময় দক্ষিণ মেরু থেকে নতুন নতুন চিত্র প্রকাশ করছে ভারতের চন্দ্রযান-৩। ভবিষ্যতে সে জায়গায় মিশনের পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়া। কী কারণে চাঁদের এই দক্ষিণ মেরু এতটা আকর্ষণীয়? এটি এমন এক জায়গা যেখানে মানুষের তৈরি কোনও কিছু আগে যায়নি। গত সপ্তাহে ক্ষুদ্র প্রজ্ঞান রোভারটি তার মাদারশিপ বিক্রম ল্যান্ডার থেকে একটি র্যাম্প দিয়ে নিচে নেমে আসে এবং চাঁদের দক্ষিণ মেরুর চারপাশে অনুসন্ধান শুরু করে। হিমশীতল, ছড়ানো ছিটানো গর্তে ভরা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করা প্রথম মহাকাশযান এটি।
১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকে অ্যাপোলো মিশনগুলি প্রাথমিকভাবে চাঁদের বিষুবরেখা বা মাঝ বরাবর টার্গেট করেছিল। ভারতের চন্দ্রযান-৩ মিশন থেকে ল্যান্ডারটি চাঁদের দক্ষিণ মেরু থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবতরণ করেছে। এর দু'দিন আগেই রাশিয়ার লুনা-২৫ মহাকাশযান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। সেই ব্যর্থ প্রচেষ্টার পরপরই ভারতের সফল অবতরণকে মানুষের চাঁদে যাওয়ার তৎপরতার প্রথম ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই দশকের শেষ দিকে মানুষ চাঁদে বিচরণ করবে এমন পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা বা নাসার।
"এটি অবিশ্বাস্য যে এমন ঘটছে," বলছিলেন যুক্তরাজ্যের দ্য ওপেন ইউনিভার্সিটির একজন গ্রহ বিষয়ক বিজ্ঞানী সিমিওন বারবার। ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন - সবার নজর এখন চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দিকে। এর পেছনে একটা উদ্দেশ্য হলো, সেখানের রহস্যঘেরা পরিবেশ সম্পর্কে অনুসন্ধান। এছাড়া যা পাওয়া যাবে সেটা কাজে লাগানোও হয়তো একটা উদ্দেশ্য। সুটকেসের আকৃতির মতো রোভারটি যে অদ্ভুত পরিবেশে রয়েছে সেটা সম্পর্কে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে।
চাঁদের ধুলোমাখা পথে প্রজ্ঞান রোভারটি প্রতি সেকেন্ডে ১ সেন্টিমিটার (০.৪ ইঞ্চি) পার করতে করতে এর মাদারশিপ থেকে বেশ কয়েক মিটার দূরে চলে এসেছে। পথে এর সেন্সর চাঁদের মাটি কিছুটা খুঁড়েও দেখেছে। তাতে তাপমাত্রার তফাতের এক অদ্ভুত চিত্র সামনে এসেছে। যেখানে চন্দ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মত উত্তপ্ত, সেখানে মাত্র ৮০ মিলিমিটার বা ৩ ইঞ্চির মতো নিচে তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রিতে নেমেছে, যেটা একেবারে হিমশীতল। এটা বিজ্ঞানীদেরও ‘অবাক’ করেছে। অবশ্য চাঁদের চরম তাপমাত্রা সম্পর্কে আগেই ধারণা দিয়েছে নাসা।
এর নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখা বরাবর দিনের বেলা তাপমাত্রা ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো থাকে, আর রাতের বেলা সেটা মাইনাস ১৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যেতে পারে। মেরু অঞ্চলে এই তাপমাত্রা আরও কম বলা হয়। যেমন উত্তর মেরুর একটি গর্তে মাইনাস ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যা সৌরজগতে পরিমাপযোগ্য তাপমাত্রার মধ্যে সর্বনিম্ন। মহাকাশযানে থাকা যন্ত্রাংশের রাসায়নিক বিশ্লেষণ বলছে চাঁদের মাটিতে সালফার, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম আয়রন, টাইটানিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম এবং অক্সিজেনের উপস্থিতি রয়েছে।
এই দুটি প্রাথমিক অনুসন্ধান ইঙ্গিত দেয় - কেন বিজ্ঞানীরা চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলটি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। উত্তর-দক্ষিণ মেরু বরাবর যে মেরুরেখায় পৃথিবী ঘোরে সেটা ২৩.৫ ডিগ্রি কাত হয়ে থাকে, তবে চাঁদের ক্ষেত্রে সেটা ১.৫ ডিগ্রি। এর অর্থ চাঁদের মেরুর বেশ কিছু গর্ত বা গহ্বরে কখনো আলোই পৌঁছায় না। কখনও কখনও তেমন গর্তকে 'অনন্ত অন্ধকারের গর্ত' বলে ডাকা হয়। এমন পরিবেশ আর নিম্ন তাপমাত্রা থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন সেখানে প্রচুর পরিমাণে বরফ জমা রয়েছে যার অনেকটাই পানি থেকে তৈরি। কোটি কোটি বছর ধরে সঞ্চিত হয়েছে এমন বরফ। হয় সে বরফ মাটির সাথে মিশে আছে, অথবা চন্দ্রপৃষ্ঠে উন্মুক্ত অবস্থাতেই আছে।
সে বরফ নভোচারীদের জন্য এক ধরণের সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এবং আশা করা হচ্ছে তা ভবিষ্যতে আরও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভিত্তি হতে পারে। “এটা একটা অনন্য জায়গা এবং পানির সহজলভ্যতা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ,” বলছিলেন ভারতের নয়াদিল্লিতে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্বের অধ্যাপক সৌমিত্র মুখার্জি। এর সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৯ সালে। সে সময় নাসা পরীক্ষামূলকভাবে একটি খালি রকেট ইচ্ছা করে দক্ষিণ মেরুর তেমন একটি গর্তে ফেলে দেয়। সে পর্যবেক্ষণ থেকে প্রমাণ মেলে যে চাঁদে পানির বরফ থাকতে পারে- বলছিলেন মার্গারেট ল্যান্ডিস, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের বোল্ডার কলোরাডো ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী।
মেরুতে উচ্চ প্রতিফলনের তথ্য ও উচ্চমাত্রায় হাইড্রোজেনও বরফের অস্তিত্ব থাকার দিকেই নির্দেশ করে। গত বছর ক্যালিফোর্নিয়ার নাসার এমস রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানী উইলিয়াম রিচ নাসার পুরনো সোফিয়া টেলিস্কোপ নিয়ে প্লেনে করে চাঁদের পর্যবেক্ষণ করেন। সেই চিত্র অনুযায়ী যেখানে হাইড্রোজেনের প্রমাণ মেলে তার বেশ কাছেই এখন চন্দ্রযান-৩ ঘোরাফেরা করছে। বরফ বা পানির অস্তিত্ব থাকাটাই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর মূল আকর্ষণের জায়গা। সেখানে ভারতের চন্দ্রযানের বিচরণ “বিজ্ঞানীদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে যেন তাদের আগের নানা ধারণা বা তত্ত্বের উপর অন্তত পরীক্ষা করতে পারেন।
সম্পাদক : মাহমুদ আনোয়ার হোসেন
নির্বাহী সম্পাদক : জুবায়ের রহমান চৌধুরী
বার্তা সম্পাদক : খালেকুজ্জামান পান্নু
বার্তা ও সম্পাদকীয় কার্যালয় : বাড়ি # ৬৩, সড়ক # ২১,
রূপনগর আ/এ, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬।
বাণিজ্যিক কার্যালয় : গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড, ঢাকা-১২১২।
ফোন : 01731-488397,01552381515, 01751345643
হোয়াটসএ্যাপ : 01826567123
Copyright © 2024 সারাবেলার সংবাদ. All rights reserved.