গৃহকর্মী হত্যা ও নির্যাতনে বিচার হয়না কেন
- আপডেট সময় : ১১:৫৩:০৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ১২১ বার পঠিত
এমনকি হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনায়ও আপসের মাধ্যমে শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যান অভিযুক্তরা।
প্রীতি উরাং নিহত হওয়ার ঘটনায় অবশ্য ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক ও স্ত্রী তানিয়া খন্দকার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। গত ৬ ফেব্রুযারি ঢাকার মোহাম্মদপুরে সৈয়দ আশফাকুলের অষ্টম তলার ফ্ল্যাট থেকে পড়ে প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যু হয়। ঘটনার পর দিন প্রীতির বাবা লোকেশ ওরাং বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। মামলায় সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারকে আসামি করা হয়।
মানবাধিকার সগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) হিসাবে গত তিন বছরে ঢাকাসহ সারা দেশে ৩৬ জন গৃহকর্মী তাদের গৃহমালিকের বাসায়মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ৯০ ভাগই নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান। কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন। এই সময়ে মোট নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১০৩ জন। কিন্তু ওইসব ঘটনায় মামলা হয়েছে অনেক কম ৬৯টি।
আসকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৪৫০ জন গৃহকর্মীকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার বিভিন্ন থানায় প্রায় দুশোর মতো নির্যাতন ও অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
গৃহশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেন বাংলাদেশ ইনস্টিাটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজ(বিলস)-এর যুগ্ম মহাসাচিব সৈয়দ সুলতান উদ্দিন খান। তিনি বলেন,” গৃহকর্মী নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা বাস্তবে আরো বেশি । যে হিসাব আপনারা দেখেন তা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। অনেক ঘটনাই সংবাদমাধ্যমে আসেনা। আর অনেক ঘটনায়ই মামলা হয়না।”
বিলস-এর এক জরিপে অংশ নেওয়া ২৮৭ জন গৃহ শ্রমিকের ৫০ ভাগ জানিয়েছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিলস-এর তথ্য বলছে, সারা দেশে মোট গৃহকর্মীদের ৯৫ ভাগেরও বেশি নারী। গৃহকর্তার কাছে ৫০ শতাংশ গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হন। যাদের অর্ধেকেই আবার শিশু।
বিলসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে সারা দেশে এক হাজার ৫৬০ গৃহকর্মী কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, আহত, রহস্যজনক মৃত্যু, আত্মহত্যা ও হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন ৫৭৮ গৃহকর্মী।
গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের সন্বয়কারী আবুল হোসেন বলেন,” গৃহশ্রমিক নির্যাতন ও নিহত হওয়ার ব্যাপারে বিচারের অভিজ্ঞতা নির্মম। বিচার পাওয়ার নজির তেমন নেই বললেই চলে। যে ঘটনাগুলোতে মামলা হয় সেখানে এজাহার খুবই দুর্বল থাকে। কারণ মালিক প্রভাবশালী থাকেন গৃহশ্রমিকের তুলনায়। তারা সহজেই পুলিশকে প্রভাবিত করতে পারেন। ফলে মামলা ওখানেই অনেকটা শেষ হয়ে যায়। আর বিচারের আগেই অর্থের বিনিময়ে বা চাপ প্রয়োগ করে আপোস করে ফেলা হয়। ফলে আর বিচার হয়না।”
বাংলাদেশে হত্যা ও নির্যাতনের মতো অপরাধের মামলা আইনে আপসযোগ্য নয়। তারপরেও কীভাবে আপস হয়? জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন,” এটা আদালতের বাইরে করা হয়। এটার নানা কৌশল আছে। প্রথমত মামলার তদন্তে দেরি করা হয়। এরমধ্যে নিহত বা নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীর পরিবার স্বাভাবিক হয়ে আসে। তারা গরিব। তাই তাদের অর্থের প্রলোভনে ফেলা হয়। তখন তারা মামলার ব্যাপারে আর আগ্রহ দেখান না। সাক্ষী দিতে যাননা। তখন মামলা এমনিতেই খারিজ হয়ে যায়।”
আর সৈয়দ সুলতান উদ্দিন খান বলেন,” কেউ যদি মামলা লড়তেও চান তাহলেও কোনো লাভ হয়না। কারণ তখন অন্য সাক্ষীদের প্রভাবিত করা হয়।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী সারা দেশে এখন ২৫ লাখ গৃহকর্মী আছেন।তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ নারী৷ জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ- অনুযায়ী দেশে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে এমন শিশুর সংখ্যা এক লাখ ২৫ হাজার, যাদের বয়স ৫ থেকে ১৭ বছর৷ আর এর মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই মেয়েশিশু৷
বাংলাদেশে গৃহশ্রমিক সুরক্ষা নীতিমালা করা হয় ২০১৫ সালে। কিন্তু সেটা কোনো আইন নয়। তাই তাদের বেতন, কর্ম পরিবেশ, কর্ম ঘণ্টা, বয়স, নিয়োগ কোনো কিছুই আইনের আওতায় হয়না। তাদের ট্রেড ইউনিয়ন করারও কোনো অধিকার নেই।
“বাংলাদেশ কর্মজীবী নারী” নামের সংগঠনটিও গৃহ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে। সংগঠনের সমন্বয়কারী নার্গিস আক্তার নীলা বলেন,” গৃহশ্রমিকেরা নির্যাতনের শিকার হন গৃহ মালিকের বাড়িতে। সেখানে সে একা থাকে। তাই সে নির্যাতনের প্রতিবাদও করতে পারেনা। আর মামলা হলে তার পক্ষে সে নিজে ছাড়া আর কোনো সাক্ষীও থাকেনা। ফলে এখানে নির্যাতন বেশি। যেমন পোশাক কর্মীরা এক সঙ্গে কাজ করেন। তাই তারা প্রতিবাদ করতে পারেনা।”