ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িত হওয়ায় আওয়ামী লীগে বিষ্ময়
- আপডেট সময় : ০৮:৪০:০৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ জুলাই ২০২৪ ৩০ বার পঠিত
বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে মঙ্গলবার দেশজুড়ে সহিংসতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িত হওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে।
বিশেষ করে প্রায় ষোল বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এবং এ অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়নের ঘটনা নিয়ে দলের মধ্যে ‘বিস্ময়’ ও ‘ক্ষোভ’ তৈরি করেছে, যার কিছুটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায়।
পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ডাকা দলের এক সভায় তিনি বলেছেন ‘আমাদের অস্তিত্বের প্রতি হামলা এসেছে, হুমকি এসেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা আমাদের করতেই হবে’।
দলটির নেতাদের অনেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ‘প্রয়োজনে’ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও বড় ধরণের অভিযানের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
“এটি এখন বিএনপি জামায়াতের আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সে কারণে আর তো ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই। আইনানুগ যা ব্যবস্থা নেয়ার তাই করা হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক।
কোটা আন্দোলনকে ‘নৈতিক সমর্থন’ জানালেও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা কোটা আন্দোলনের সাথে যুক্ত নয়।
আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকেও বারবার বলা হয়েছে, এটি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং তাদের আন্দোলনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করার জন্য এসব বক্তব্য দেয়া হচ্ছে বলে তারা মনে করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাদের রুম ভাংচুর হয়েছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলছেন, “তারা তাণ্ডব চালিয়েছে। এটা বেশীক্ষণ চলতে দেয়া হবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
‘সহিংসতা’ ও ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগে আলোচনা
শুরুতে কোটা বিরোধী আন্দোলনের ছাত্রলীগেরও অনেক নেতাকর্মী জড়িয়ে পড়া এবং কোটা বিষয়টি ‘জনপ্রিয় ইস্যু’তে পরিণত হওয়ায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার পক্ষে খুব একটা মতামত ছিলো না বলে জানিয়েছেন দলটির একাধিক নেতা।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদের পর দলের মধ্যে নানা ধরণের আলোচনা শুরু হয়।
তবে দলটির নেতারা ধারণা করেছিলেন বিষয়টি ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং কোটা ইস্যু নিয়ে উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসলে বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে।
সে কারণেই সরাসরি বাধা না দিয়ে ছাত্রলীগকে দিয়ে আন্দোলনকারীদের কিছুটা চাপে রাখার নীতি নিয়েছিলো সরকারি দলের শীর্ষ মহল।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সোমবারই বলেছিলেন যে রবিবার রাতে ক্যাম্পাসে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ হয়েছে তার জবাব দেয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত।
সোমবারেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগরসহ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগের হামলায় কয়েক শত আন্দোলনকারী আহত হয়েছে বলে জানায় তাদের জোট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
পরে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেও তাদের কর্মী আহত হওয়ার অভিযোগ করা হয়।
কিন্তু সেই ছাত্রলীগকেই মঙ্গলবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বের করে দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। এতে করে ছাত্রলীগ নিজেই ক্ষোভের মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে।
দলের নেতাদের কয়েকজন জানিয়েছেন ‘ছাত্রলীগ যে পারবে না বা তাদের যে সেই সক্ষমতা নেই’- সেটা কারও চিন্তাতেও আসেনি।
যদিও একজন নেতা বলেছেন যে ‘ছাত্রলীগকে নিয়ে দুদিন ধরেই একটি প্রচারণা চলছিলো এবং তাদের কোটা আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা করছিলো আন্দোলনকারীদের একাংশ।
ফলে তাদের সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো। বিশেষ করে সরাসরি সহিংসতা জড়িয়ে যেন না পড়ে সেটি খেয়াল রাখতে বলা হয়েছিলো’।
তবে আওয়ামী লীগের মধ্যম পর্যায়ের একজন নেতা বলেছেন, “ছাত্রলীগ তো বলেছিলো টেনশন না করার জন্য। কিন্তু তারা তা পারেনি। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে তো মহানগর ছাত্রলীগ গিয়ে সহায়তা করতে হয়েছে”।
যদিও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলছেন যে তারা সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগকে আলাদা করে দেখেন না। তার দাবি “এখন সব ছাত্রদল ও শিবিরের সন্ত্রাসীরা তান্ডব করেছে’।
আর এ অবস্থায় দলের নেতারা যে ইঙ্গিত দিচ্ছেন তা হলো সরকার এখন ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ অবস্থায় আছে এবং এখানে পিছিয়ে আসার কোন সুযোগ নেই বলেই তারা মনে করেন।
সে কারণেই পুরো মহানগর আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ওবায়দুল কাদের দলীয় সভায় বলেছেন, “আমাদের অস্তিত্বের প্রতি হামলা এসেছে, হুমকি এসেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা আমাদের করতেই হবে। কাজেই আপনারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রস্তুত হয়ে যান”।
একজন সিনিয়র নেতা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ছাত্রলীগের ওপর নির্ভর না করে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাজে লাগানো হবে এবং তাদেরকেও যতটা ‘কঠোর হওয়া দরকার’ তাই হবার নির্দেশনা দেয়া হবে।
দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলছেন আগে চিন্তা ছিলো যে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত আসার পর আলোচনার মাধ্যমে এবং সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
“এখন সব সমাধান হয়ে যাবে। আইনগতভাবে চাপ তৈরিতে যা করার দরকার সেটাই করা হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি সরকারি চাকরীতে কোটা বিষয়ে উচ্চ আদালতের এক রায়ের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং তারা কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন শুরু করে।
পরে রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সেদিন রাত থেকেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে।
চীন সফর উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার বলেন, ”কোটা নিয়ে আদালত থেকে সমাধান না আসেলে সরকারের কিছু করার নেই।”
তিনি প্রশ্ন রাখেন, ”মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?”
সেই বক্তব্যের জের ধরে সেনদিন মধ্যরাতে বিক্ষোভ করতে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, সিলেটের শাহজালাল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জের ধরে তারা শ্লোগান দিতে থাকেন।
এর ধারাবাহিকতায় সোমবার সহিংসতার পর মঙ্গলবার সেই সহিংসতা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে সংঘর্ষে ছয় জন নিহত হয়।
মঙ্গলবার রাতেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের বের করে দেয় আন্দোলনকারীদের একাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের কক্ষগুলোতে ব্যাপক ভাংচুর করা হয়।বিবিসি