একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে চামড়া শিল্প
- আপডেট সময় : ০৮:০৮:১০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ জুন ২০২৪ ২০ বার পঠিত
কোরবানির ঈদে সরকার নির্ধারিত দামেরও অর্ধেক দামে বিক্রি হয়েছে কাঁচা চামড়া। চামড়া রপ্তানি আগে থেকেই কমছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদার চামড়াজাত পণ্যের ৪০ ভাগ আমদানি করা হয়। চামড়া শিল্প সম্ভাবনাময় হলেওও এই পরিস্থিতি কেন?
চামড়া শিল্প থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫০০ কোটি ডলারের। তবে তা ঘুরপাক খাচ্ছে ১০০ কোটি ডলারের ঘরে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-র তথ্য বলছে, চলতি অর্থ-বছর (২০২৩-২০২৪)-এর জুলাই থেকে মে পর্যন্ত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের আয় ১৪. ১৭ শতাংশ কমে হয়েছে ৯৬ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগের একই সময়ে তা ছিল ১১২ কোটি ডলার। এ সময়ে চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল প্রায় ৪৬৮ বিলিয়ন বা ৪৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। চামড়ার বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের অংশ মাত্র ০.২৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, “চামড়া, চামড়াজাত পণ্য সব কিছুর রপ্তানিই কমে গেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি বাইরের বাজারে অর্ডার অনেক কমে গেছে। আবার অভ্যন্তরীণ চাহিদাও কমছে। সব মিলিয়ে আমাদের চামড়া শিল্প এখন খারাপ অবস্থায় আছে।”
বাংলাদেশ লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বাংলাদেশের রপ্তানির চেয়ে বেশি অভ্যন্তরীন চাহিদা। এটা ২০১৮ সালে ছিল ১৪০ কোটি ডলারের। তবে তার মধ্যে ৪০ শতাংশ আমদানি হতো। সেই চাহিদা কমে ১০০ কেটি ডলারের নিচে নেমেছে। ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবসা দুটিই খারাপ অবস্থায় রয়েছে।
চামড়াজাত পন্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চামড়াশিল্পের মানসনদ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডাব্লিউজি) সনদ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এলডাব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ট্যানারি আছে মাত্র ৬ টি। তবে ভারতে রয়েছে ১৩৯টি, চীনে ১০৩, ইটালিতে ৬৮, ব্রাজিলে ৬০, তাইওয়ানে ২৪, স্পেনে ১৭, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কে ১৬ ও ভিয়েতনামে রয়েছে ১৪টি। এই সনদ না থাকার কারণে বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত দেশীয় কাঁচা চামড়া থাকার পরও রপ্তানিমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পকারখানাগুলোকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার এলডাব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ফিনিশড চামড়া আমদানি করতে হয়।
দূষণমুক্ত উন্নত পরিবেশে চামড়া উৎপাদনই কমপ্লায়েন্সের মূল শর্ত। এর সঙ্গে আছে সঠিক পদ্ধতিতে মান বজায় রেখে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)-এর এক গবেষণা অনুসারে সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি)-র সক্ষমতার অভাব, কমপ্লায়েন্স সম্পর্কে ট্যানারি মালিকদের যথাযথ ধারণা না থাকা, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও ট্যানারির অভ্যন্তরীণ পরিবেশের মান উন্নত না হওয়ার কারণে কারখানাগুলো এলডাব্লিউজি সনদ পাচ্ছে না।
বিসিকের সাবেক চামড়া বিশেষজ্ঞ এবং লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, “সাভারে চামড়া শিল্প স্থানান্তর করা এক ধাপ অগ্রগতি। সেখানে অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু কারখানার পরিবেশ ও কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার সঠিকভাবে গড়ে তোলা হয়নি। সেটা না হওয়ায় আসলে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারছে না।”
“একইভাবে অনেক কারখানাই আধুনিক নয়। তারা আগের প্রচলিত পদ্ধতিতেই কাজ করছেন,” বলেন তিনি।
তার মতে, চামড়া বোর্ড গঠন করে এই বিষয়গুলো দেখা উচিত।
ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, “পরিবেশ এবং সোশাল দুই ধরনের কমপ্লায়েন্সেরই প্রয়োজন হয়, যা কারাখানাগুলোর নাই। ফলে এলডব্লিউজি সনদ পাচ্ছে না। আবার ব্র্যান্ডগুলোও গ্রহণ করছে না।”
তার কথা, ” রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার কারণ রপ্তানির পরিমাণ কমে যাওয়া নয়। আসলে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কারখানা মালিকরা। রপ্তানির তালিকায় অনেক দেশ থাকলেও এখন প্রধানত চীনে বেশি রপ্তানি হয়।”
বিশ্বব্যাপী চামড়াজাত পণ্যের বাজারের আকার প্রায় ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের, যার ৩০ শতাংশ দখল করে আছে চীন।
শাহীন আহমেদ বলেন, “এখানে দুই ধরনের বাস্তবতা আছে। আমাদের কারখানাগুলো যেমন কমপ্লায়েন্স না, আবার আন্তর্জাতিক বাজারেও চাহিদা কমে গেছে। বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক খারাপ অবস্থা তার কারণে চাহিদা কমছে। ইউরোপে চাহিদা কমছে। আবার ব্যাপক মূল্যস্ফীতির কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারেও চাহিদা অনেক কমে গেছে চামড়াজাত পণ্যের। মানুষ এখন খাদ্য কিনবে, না ফ্যাশন করবে সেই প্রশ্ন এসে গেছে। আর আর্টিফিসিয়াল লেদারও চামড়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।”
এদিকে এবার কোরবানির ঈদে সরকার নির্ধারিত দামেরও অর্ধেক দামে কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে। কাঁচা চামড়ার দাম না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আসলে এটা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কম হওয়ার একটি কারণ। কিন্তু সেই কারণে এত দাম কম হওয়ার কথা নয়। এখানে একটি সিন্ডিকেট আছে, যারা সংঘবদ্ধভাবে কম দামে কাঁচা চামড়া কিনে বেশি লাভ করে।” একই কথা বলেন আবুল কালাম আজাদ । তার মতে, “কাঁচা চামড়া কয়েক হাত ঘুরে কারখানায় যায়। ফলে কয়েক ধাপে মধ্যস্বত্ব ভোগী থাকে।”
বাংলাদেশে এখনো চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি পণ্যের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। তৈরি পোশাকের পরই এর অবস্থান। ডয়চে ভেলে