প্রায় দুইশো রোহিঙ্গা শরণার্থীতে ঠাসা নৌকাটি গভীর সাগরে যখন দৃশ্যমান হলো, তখন ক্রমশ যাত্রীদের চীৎকার শোনা গেল। তাদের মধ্যে ছিল বেশ কিছু শিশু এবং তাদের বাবা-মা। তারা বাঁচার জন্য সাহায্য চাইছিল।
কক্সবাজারে শিবিরের ক্রমবর্ধমান গ্যাং সহিংসতা এবং খাদ্যাভাব এড়াতে ঐসব রোহিঙ্গা ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্র যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু তাদের নৌকার ইঞ্জিন ভেঙ্গে যাওয়াতে তারা আন্দামান সাগরে লক্ষ্যহীনভাবে ভাসছিলেন।
সাময়িকভাবে মনে হয়েছিল, রোহিঙ্গা যাত্রীবাহী আরেকটি নৌকা তাদের জীবন রক্ষা করতে যাচ্ছে।
বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের ভাষ্য
এই দুই নৌকার মধ্যে যেটি কোনোমতে আচেহ পৌঁছায়, তার পাঁচজন যাত্রী এপি-র কাছে ঐ সাক্ষাতের ঘটনার কথা বলেছেন। দু'শ রোহিঙ্গা নিয়ে কয়েক সপ্তাহ আগে যে নৌকাটি হারিয়ে যায়, তার পরিস্থিতি সম্পর্কে এই প্রথম কোনো ক্লু পাওয়া গেল।
গত ২ ডিসেম্বর জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ঐ দুইটি নৌকা উদ্ধারের জন্য জরুরি বার্তা পাঠিয়েছিল।
একশ আশি জন যাত্রীবাহী ঐ নৌকায় ছিলেন ৩১ বছর বয়ষ্ক মোহামেদ জুবায়ের, তার তিন সন্তান, স্ত্রী এবং স্ত্রীর ভাই। জুবায়ের বলেন, "আমি ভাবছিলাম আমরা একসাথে সবাই ডুবে মরবো।"
[caption id="attachment_11247" align="alignnone" width="501"] ইন্দোনেশিয়ার কাছে সাগরে আটকে আছে রোহিঙ্গা বহনকারী একটি নৌকা। ছবিটি সামাজিক গণমাধ্যমের ভিডিও থেকে নেয়া[/caption]
কক্সবাজার থেকে যাত্রা শুরু
নিখোঁজ নৌকাটির গল্প শুরু হয়েছিল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির থেকে। যেখানে ২০১৭ সালে সাড়ে সাত লক্ষ রোহিঙ্গা গিয়ে আশ্রয় নেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হামলা থেকে প্রাণে বাঁচতে।
ঐ শিবিরে থাকতেন নুর ফাতিমা এবং তার ১৪ বছর বয়সী ভাই মোহামেদ আনসার।
আনসারের পরিবার আশা করেছিল, সে ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে কাজ পাবে এবং তার উপার্জন দিয়ে পরিবারকে সাহায্য করবে। কারণ কক্সবাজারে শিবিরের বাসিন্দাদের কাজ করা নিষেধ। তাদের দেয়া হয় খাবার রেশন। এ বছর সেটিও কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
আনসার, আত্মীয় সামিরা খাতুন এবং তার ৩ বছরের সন্তান ২০ নভেম্বর অন্যদের সাথে সাগর যাত্রা করে।
ফাতিমা ভেবেছিল এর আগে আরও কিছু নৌকা নিরাপদে ইন্দোনেশিয়া পৌঁছেছে, আনসারের নৌকাও পৌঁছোবে। ।
পরের দিন সামিরা ফাতিমার পরিবারকে ফোনে জানায়, তারা নৌকায় রওনা হয়েছে, "আমাদের জন্য দোয়া কইরেন।"
গভীর সাগরে দুই নৌকার সাক্ষাৎ
জুবায়ের এবং তার পরিবার অন্য একটি রোহিঙ্গাবহনকারী নৌকায় ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছিল।
যাত্রাপথে কয়েক দিন পর জুবায়েরের সেই নৌকা আনসার আর সামিরাকে বহনকারী নৌকাটিকে দেখে। আনসারের নৌকার ইঞ্জিন ভেঙ্গে গিয়েছিল এবং পানি উঠছিল।
জুবায়েরের সহযাত্রী রুজিনা জানান, তারা ভয় পাচ্ছিলেন অন্য নৌকাটির কাছে গেলে সেটির যাত্রীরা এই নৌকায় আসার জন্য ঝাঁপ দেবে।
সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে
দুই তিনদিন ধরে দুইটি নৌকা একসঙ্গে এগোচ্ছিল। কিন্তু বিপুল এক সামুদ্রিক ঝড় আসায় জুবায়েরের নৌকার ইঞ্জিন ভেঙ্গে যায়।
আর তখন দুই নৌকার মধ্যেকার রশি ছিঁড়ে যায়।
জুবায়ের শুনতে পান, অন্য নৌকার যাত্রীরা বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে।
"তারা কাঁদছিল, চীৎকার করছিল, 'আমাদের রশি ছিঁড়ে গেছে! আমাদের বাঁচান!' কিন্তু আমরা কিভাবে বাঁচাবো? আমরাও তো তাদের সাথে মারা যেতাম।"
এরপর ঐ নৌকাটি তাদের দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যায়।
[caption id="attachment_11248" align="aligncenter" width="547"] আগুনে ঘর পুড়ে যাবার পর রোহিঙ্গা কিশোরী সোফিয়া খাতুন নতুন করে ঘর বানাচ্ছে। বালুখালি, কক্সবাজার[/caption]
উদ্ধার অভিযান
জুবায়ের এবং তার সহযাত্রীরা পানি এবং খাবার ছাড়া কয়েকদিন ধরে নৌকায় ভাসতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত একটি বিমান তাদের চিহ্নিত করে।
একটি নৌজাহাজ এসে তাদের খাবার দেয় এবং ইন্দোনেশিয়ার উপকূলের কাছ পর্যন্ত টেনে এগিয়ে দেয়।
জুবায়ের বলছেন, এরপর তাদের মাঝিরা অন্য একটি নৌকায় করে পালিয়ে যায়। যাত্রীরা কোনোমতে তীরে পৌঁছোন।
নিখোঁজ যাত্রীদের উদ্ধারে অবহেলার অভিযোগ
ইন্দোনেশিয়ায় ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিনিধি অ্যান মেইমান আঞ্চলিক সরকারগুলোকে উদ্ধার অভিযান চালানোর অনুরোধ করেন। তিনি এপি-কে বলেন, "এই অঞ্চলের দেশগুলো উদ্ধার অভিযান চালানোর জন্য সম্পূর্ণ সক্ষম।"
প্রিয়জনের খবরের অপেক্ষায় পরিবারগুলো
ওদিকে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে তৈরি হয়েছে আশংকা। কারণ তারা গত বছর ১৮০ জন রোহিঙ্গা বহনকারী আরেকটি নৌকা নিখোঁজ হবার পর প্রিয়জনদের হারিয়েছে।
ফাতিমা অপেক্ষা করে থাকেন আনসারের খবর জানার জন্য। প্রায় রাতে তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেন।
তিনি জানান, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন আনসার তার মায়ের কাছে এসে একদিন বলছে, সে একটি দ্বীপে গিয়ে উঠেছিল।
আনসারের পরিবার বুকে আশা ধরে রাখে, এখনও তারা বিশ্বাস করে, আনসার বেঁচে আছে, কোথাও না কোথাও।
সম্পাদক : মাহমুদ আনোয়ার হোসেন
নির্বাহী সম্পাদক : জুবায়ের রহমান চৌধুরী
বার্তা সম্পাদক : খালেকুজ্জামান পান্নু
বার্তা ও সম্পাদকীয় কার্যালয় : বাড়ি # ৬৩, সড়ক # ২১,
রূপনগর আ/এ, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬।
বাণিজ্যিক কার্যালয় : গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড, ঢাকা-১২১২।
ফোন : 01731-488397,01552381515, 01751345643
হোয়াটসএ্যাপ : 01826567123
Copyright © 2024 সারাবেলার সংবাদ. All rights reserved.