হিন্দু নেতারা ‘আওয়ামী ভোটব্যাংক’ কিংবা ‘ভারতপন্থী তকমা’ থেকে বের হতে চান
- আপডেট সময় : ১২:২৭:৩৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪ ১০ বার পঠিত
হিন্দুরা 'কোনও দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না' বলে সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রামের পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস।
ঢাকার অভয় দাস লেনে ভোলানন্দ গিরি আশ্রম। সেখানেই সান্ধ্য আরতি বা প্রার্থনায় বসেছেন জনা বিশেক সনাতন ধর্মের অনুসারী। প্রার্থনা শেষে কথা হয় তাদেরই একজন সুস্মিতা দেবীর সঙ্গে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে, সুস্মিতা দেবী জানালেন মন্দিরে নিয়মিত আসলেও এখন একটা ‘ভয় ঢুকে গেছে মনে’।
“এই যে হামলা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। আমার নিজের আত্মীয়ের বাড়িতেও এবং মন্দিরে হামলা হয়েছে। তারা কোনও দলীয় লোক ছিল না। আমি নিজে সরাসরি হামলার শিকার হইনি, কিন্তু এগুলো দেখে ভয় তো লাগে,” বলছিলেন সুস্মিতা দেবী।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে যখন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজার আয়োজন চলছে, তখন সুস্মিতা দেবীর মতো হিন্দুদের অনেকেই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানাচ্ছেন।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার অভিযোগ এনে এর প্রতিবাদে গেলো দুই মাসে বিক্ষোভ-সমাবেশও করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা।
এসব সমাবেশগুলোতে রাজনীতি নিয়ে এমনসব বক্তব্য উঠে আসছে, যেগুলো এর আগে সেভাবে শোনা যায়নি।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব হিন্দু নেতাদের এতোদিন সামনে দেখা যেতো, এসব বিক্ষোভে তাদের উপস্থিতি দেখা যায়নি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক কী দাবিতে এমন বড় আয়োজনে বিক্ষোভ করছেন সনাতন ধর্মের অনুসারীরা?
আর এসব বিক্ষোভের মাধ্যমে কী বার্তা দিতে চাচ্ছেন তারা?
হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘ব্যাপক ক্ষোভের’ কারণ কী?
সাম্প্রতিককালে ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে সনাতন ধর্মানুসারীদের বিভিন্ন সমাবেশে যেভাবে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে, তাকে সংখ্যালঘু নেতারা ব্যাখ্যা করছেন ‘ব্যাপক ক্ষোভের’ বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।
অনেকটা তাৎক্ষণিক এসব বিক্ষোভ আলোড়ন তুলেছে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে।
শুরুতে বিভিন্ন সংগঠন বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভের আয়োজন করলেও পরে এটা করা হচ্ছে সমন্বিতভাবে ‘সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটে’র ব্যানারে।
তবে বাংলাদেশে হিন্দুদের মন্দির কিংবা বাড়িঘরে হামলার ঘটনা নতুন নয়। এর আগে বিভিন্ন সময় এরকম ঘটনা ঘটলেও তখন সংখ্যালঘুদের এতো বড় আয়োজনে বিক্ষোভ দেখা যায়নি।
কিন্তু এবার তাহলে সারাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর অনেকেরই এমন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার কারণ কী?
“আমাদের আসলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। এই অনুভূতিটাই সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সবাই সামনে এসে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়ার চেষ্টা করেছে।”
বলছিলেন সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের উপদেষ্টা অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস।
“এর আগে যেসব হামলা হয়েছে, সেগুলো হয়েছে অনেকটা নির্দিষ্ট এলাকায় বা নির্দিষ্ট গ্রামে। সেটারও একটা প্রভাব তখন দেখা গিয়েছে। কিন্তু হামলার ব্যাপকতা এবারে যেন সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে এটা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। ফলে এই সময়েই একটা ভীষণ ভয়, হতাশা, আতঙ্ক চলে আসলো সবার মনে। সকলেই বলছিলো, এমনকি আমার গ্রামেও এরকম কথা কেউ এর আগে বলেনি। সেটা হচ্ছে যে, আমরা মনে হয় আর থাকতে পারবো না। এই যে আতঙ্ক সেটাই মানুষকে সংঘবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে।”
‘কারো ইন্ধনে আন্দোলন করছি না’
এবারে ঢাকা কিংবা ঢাকার বাইরে সংখ্যালঘুদের জমায়েতে বেশি অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে মূলত তরুণ-যুবকদের। আর এর পেছনে মূল ভূমিকা রাখছেন ছাত্ররা।
বড় সমাগমের পাশাপাশি বিক্ষোভগুলোতে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটা হচ্ছে, রাজনৈতিক পরিচয় আছে এমন নেতাদের অংশগ্রহণ নেই।
এমনকি গেলো দুই দশকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদেরকেও সমাবেশে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে আন্দোলনে সাধারণ হিন্দুদের পাশাপাশি সাধু-সন্তুদের সক্রিয় ভূমিকা দেখা গেছে।
আন্দোলনের সংগঠকরা জানাচ্ছেন, আন্দোলনে যেন কোনও রাজনৈতিক চোহারা না থাকে, কেউ যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একে ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য তারা সচেতন আছেন।
“যারা আগে রাজনৈতিক পদধারী ছিলেন বা রাজনীতির লেবেল আছে, তাদেরকে আমরা সামনে আনছি না। এবং তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেও সামনে আসছেন না। যারা বিভিন্ন সময় সরকারদলীয় ছিলেন, তাদের আমাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার দরকার নাই। আমরা আমাদের মতো রাজপথে আন্দোলন করে যাবো, তারা যেন বিঘ্ন তৈরি না করে,” বলছিলেন আন্দোলনের একজন সংগঠক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নির্মল বিশ্বাস।
কিন্তু এর মাধ্যমে কী অর্জন করতে চান তারা এমন প্রশ্নে মি. বিশ্বাস বলছেন, আন্দোলন যেন বিতর্কিত না হয় সেজন্যই তারা রাজনীতিসংশ্লিষ্টদের দূরে রাখছেন।
“অনেকে হয়তো এটা বলবে যে, আওয়ামী লীগ সরকারকে ফিরিয়ে আনতে আন্দোলন করছে সংখ্যালঘুরা। আমরা আওয়ামী লীগ সরকারকে ফিরিয়ে আনার আন্দোলন করছি না। কিন্তু রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা এখানে থাকলে আমাদেরকে ট্যাগ দিয়ে দমন করার ষড়যন্ত্র হতে পারে। আমাদের তো দেশকে অস্থিতিশীল করার কোনও টার্গেট বা অভিপ্রায় নেই। কারোও ইন্ধনেও আমরা রাজপথে নামি নাই। আমরা মাঠে নেমেছি শুধুমাত্র আমাদের আট দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য। এটাই আমাদের উদ্দেশ্য, ”বলছিলেন নির্মল বিশ্বাস।