বিশেষ করে রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ বিভিন্ন তহবিলে যে অর্থ দিয়েছে সরকার সেগুলোর পাশাপাশি পায়রা বন্দর ও উড়োজাহাজ কিনতে বাংলাদেশকে বিমানের জন্য যে অর্থ দেয়া হয়েছে সেগুলো রিজার্ভের হিসেব থেকে বাদ দেয়ার বিষয়ে অনড় রয়েছে আইএমএফ। ঢাকায় এখন আইএমএফ মিশনের কাছে এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়।
তবে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান আগেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে রিজার্ভসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের কাজটি করবে সামনের নির্বাচনের পর গঠিত সরকার। দ্বিতীয় কিস্তি পেতে সমস্যা হবে : অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, রিজার্ভ ও রাজস্ব আহরণসহ অনেকগুলো বিষয়ে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলেও ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
যদিও মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট মোকাবেলা, খেলাপি ঋণ এবং জ্বালানি তেলের দাম ছাড়াও চলতি সফরে আরও যেসব বিষয়ে আইএমএফ-এর উদ্বেগ আছে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে সংস্থাটির প্রতিনিধি দলের সাথে। বিশেষ করে সংস্থাটির সাথে জ্বালানি তেলের বিশেষ করে বিপিসি যেসব জ্বালানি বিক্রি করে সেগুলোর দাম নির্ধারণের জন্য একটি ফর্মুলা ঘোষণা করার কথা থাকলেও বাংলাদেশ এখনো তা করতে পারেনি।
এ নিয়ে আইএমএফ এর মধ্যেই তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। “এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আবার কিছু ক্ষেত্রে নেয়া পদক্ষেপ সঠিক ছিলো না। ডলারের দাম বাজার ভিত্তিক হয়নি। খেলাপি ঋণ নিয়েও উদ্বেগ আছে আইএমএফ-এর,” বলছিলেন জাহিদ হোসেন। এখন উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা শেষ যেসব বিষয়ে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি আর যেসব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার পদক্ষেপ নিতে পারেনি সেগুলো নিয়ে নতুন পরামর্শ আসতে পারে আইএমএফ-এর দিক থেকে।
জাহিদ হোসেন বলছেন, “এখন তারা হয়তো বলবে তোমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারোনি। তোমাদের পলিসি কাজ করেনি। সুচিন্তিত পদক্ষেপ না। তারা অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করবে। তাগিদ দিবে। কিন্তু মনে হয় না দ্বিতীয় কিস্তি আটকাবে”। আহসান এইচ মনসুর বলছেন সরকারের পদক্ষেপ ও নীতিগুলো কতটা কার্যকর হচ্ছে বা সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে কী-না বা কখন নিতে যাচ্ছে- এসব গুলো ঋণ পর্যালোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে আইএমএফ-এর কাছে।
“এসব বিষয়ে সংস্থাটি পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট না হতে পারলে এখন কিস্তি প্রাপ্তি আটকে যাওয়াটাও অসম্ভব বিষয় নয়। যদিও বিষয়টি নির্ভর করছে বাংলাদেশ কোন বিষয়ে কী ব্যাখ্যা দেয় এবং তাদের কর্মপরিকল্পনা কী তার ওপর,” বলছিলেন তিনি। গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ডঃ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন রিজার্ভের ক্ষেত্রে আইএমএফ দেখতে পারে যে রিজার্ভ লক্ষ্য অর্জন না হলেও সেটি সামনে আরও কমতে পারে কী না তার ইঙ্গিত আছে কী না। “বাস্তবতা হলো এখন রিজার্ভ স্থিতিশীলও রাখা যাচ্ছে না। বরং পতনের দিকেই আছে।
তাই এটি লোন রিভিউর ক্ষেত্রে বড় বিবেচনায় থাকবে বলে মনে হয়। সেক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে আইএমএফ এমন কিছু পদক্ষেপ চাইতে পারে যাতে রিজার্ভের পতন ঠেকানোর নিশ্চয়তা পাওয়া যায়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন গোলাম মোয়াজ্জেম। 'টেনশন তৈরি হবার আশঙ্কা': তবে তারপরেও যদি কোন কারণে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেতে বিলম্ব হয় বাংলাদেশের তাহলে জরুরি আমদানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরও অনেক কাটছাঁট করতে হতে পারে বা এ নিয়ে অর্থনীতিতে নতুন করে টেনশন তৈরি হতে পারে বলেও আশংকা আছে।
বিশেষ করে জ্বালানি খাতে এখন বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ১৫-২০ মিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করতে হয়। ঋণ পেতে বিলম্ব এলে জ্বালানির এই খরচ কমাতে গিয়ে লোডশেডিং আরও অনেক বাড়াতে হতে পারে। “পাশাপাশি পণ্য আমদানি এখন যা কমিয়ে আনা হয়েছে, আইএমএফ’র অর্থ পেতে বিলম্ব হলে আরও কৃচ্ছতা দরকার হতে পার। বলেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। বিশ্লেষকরা বলছেন পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। বিশেষ করে আইএমএফ যে প্রক্রিয়ায় কাজ করে তাতে তারা তাদের প্রতিটি শর্তের ক্ষেত্রে নেয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করে না।
প্রসঙ্গত, আইএমএফর দলটি চলতি মাসে ঢাকায় কাজ শেষ করার পর ওয়াশিংটন ফিরে গিয়ে তাদের প্রতিবেদন সংস্থার বোর্ডে উত্থাপন করবে। এরপর সেখানে তারা নিজেরা পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করবে এবং পাশাপাশি আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে এমনিতেই দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেতে ডিসেম্বর পার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা: চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড়ের পর থেকেই বড় আলোচনা ছিলো আইএমএফ এর শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে কি-না।
সংস্থাটির নির্দেশনা অনুযায়ী চলতি বছর অন্তত চার লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করার টার্গেট অর্জন করতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরকে। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে কর সাড়ে ৬১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের যে প্রতিশ্রুতি ঋণ প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশ দিয়েছিলো তা অর্জনেও বেশ পিছিয়ে আছে এনবিআর। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিলো।
সবমিলিয়ে লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে এগার শতাংশ কম রাজস্ব আদায় হয়েছিলো গত বছর। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৬ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম তিনমাসে ৬১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের প্রতিশ্রুতি পূরণেও পিছিয়ে আছে এনবিআর। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য জানিয়েছে নির্ধারিত হারে ট্যাক্স রেভিনিউ অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে বুধবারের বৈঠকে আইএমএফ মিশনকে অবহিত করা হয়েছে।
সফররত মিশনটির সাথে বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তবে গণমাধ্যমে আসা খবর অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে যেসব সংস্কারের পরামর্শ সংস্থাটি বাংলাদেশকে দিয়েছিলো সেগুলো কার্যকরে জোরালো পদক্ষেপ এখনি নির্বাচনের আগে নিতে সরকার উৎসাহী নয়। তবে সরকারের দিক থেকে একাধিকবার সংস্থাটি আশ্বস্ত করা হয়েছে যে নির্বাচনের পর নতুন সরকার এসে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। বিবিসি